আমি যখন পুনর্বাসন কেন্দ্রে ছিলাম, কতো স্বামী-ভাই-বাবা এসেছেন মুসলমান সমাজের কিছু মেয়ে, বউকে কেউ ফিরিয়ে নেন নি। একজন আর্মি অফিসারও ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। বউকে বললেন মাসে মাসে টাকা দিতে পারে কিন্তু ঘরে নিতে পারবেন না। মনে হয় তিনি এতোদিনে জেনারেল হয়ে গেছেন তার বীররে পুরস্কার পেয়েছেন, আর সুলতানা সম্ভবত টান বাজারে জীবনযুদ্ধের শেষ লড়াইয়ে ব্যস্ত। ভাবি ওই মিলিদের বাড়ির সেই শরীয়তউল্লাহরা কি সব মুক্তিযুদ্ধে মরে গেছে। আমার কি মনে হয় জানো, মুসলমানরা লেখাপড়া শিখে বেশি বেশি ভদ্র হয়েছে, হিন্দুদের অনুকরণ করে তাদের সমান হয়েছে। তাই তারাও ঘর পায় নি আর সুলতানার স্বামী সন্তান জোটে নি।
হঠাৎ হাতঘড়িটা দেখে বললো তারা, কি সর্বনাশ! তিনটে বাজে যাও যাও তুমি শুতে যাও। ছিঃ ছিঃ আমি তোমাকে এতো কষ্ট দিলাম। হেসে বললাম, আমরা তো তোমার প্রাপ্য তোমাকে দিই নি। আমাকে কষ্ট দেবার অধিকার তো তোমার আছে। না না, তবুও হ্যাঁ, তোমাকে শেষ কথাটা বলে যাচ্ছি নীলা আপা, আমি নিয়েলকেও বলে রেখেছি আমার মৃত্যুর পর আমাকে কেউ বাংলাদেশে নেবার চেষ্টা করো না। জন্ম দিলে জননী হওয়া যায় কিন্তু লালন পালন না করলে মা হওয়া যায় না। আমি জনেছিলাম সোনার বাংলায়, লালিত হচ্ছি ডেনমার্কের কঠিন ভূমিতে। তবুও সেই মাটিতেই হবে আমার শেষ শয্যা। দেশে ফিরে আমি সামান্য একটি অজ্ঞাত উপেক্ষিত মেয়ে। কিন্তু প্রতি নিশ্বাসে আমি অভিশাপ দেই বাঙালি সমাজকে তার হীনমন্যতার জন্যে, মাকে অসম্মান, অপমান করাবার জন্য। একটি মাত্র মানুষ ও দেশে জন্মেছিল, তার স্নেহস্পর্শে আমি ধন্য হয়েছি। আমি তো তুচ্ছ অনাদরে কন্যা। তোমরা পিতঘাতী, সমস্ত বিশ্ব আজ তোমাদের ধিক্কার দিচ্ছে কুচক্রী পিতৃহন্তা, লোভী ইতর। বিশ্বসভায় তোমাদের স্থান নেই। ওখানেই সোফায় আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরে তারা শুয়ে পড়লো।
তারপর দেখা হয়েছে নব্বইয়ে। টমাস সাংবাদিক, নোরা ডাক্তার দ্বার পথে। নিয়েলের মা মারা গেছেন। বাবা আছেন। ওরা পালা করে দেখাশোনা করে। কিন্তু তারা কেমন যেন নিভে যাচ্ছে। ওকে আড়াল করে নিয়ে আমাকে বললো, অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে। দেহ সুস্থ। আমার মা মারা যাবার পর ও কেমন যেন হয়ে। যাচ্ছে। একমাত্র টমাসের সঙ্গে কথা বলে আর আমরা জিজ্ঞেস করলে জবাব পাই। নীলা, তুমি ওকে একটু বোঝাও। সন্ধ্যায় দু’জনে বসে আছি মুখোমুখি। তারা হঠাৎ উঠে এসে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। কেন? কেন? সবাই সব কিছু পারে আর আমি শুধু হারাববা? কেন? কেন নীলা আপা, বলো? আমি ওর মাথাটা বুকের ভেতরে টেনে নিয়ে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর ও উঠলো। মুখ ধুয়ে কফি করে নিয়ে এলো। আগের মতোই তারা জ্বলছে, ওর চোখের আলো আবার যেন আমার সারা দেহমন আলোকিত করে দিলো। নিয়েল ঠিকই ধরেছে ও, ওর মা এবং শাশুড়ি উভয়ের সমন্বয়ে যাকে পেয়েছিল তাকে হারানোর পর থেকেই এ রক্তক্ষরণ। এতো কষ্ট ও সহ্য করেছে যে তারও সীমারেখায় যেন পৌঁছে গেছে ওর সহিষ্ণুতা।
নববর্ষে কার্ড পাই। ভালো আছি, মঙ্গল চাই। বিনিময়ে আমারও ওই একই শুভেচ্ছা ভালো থেকো, আনন্দে থেকো।
২. মেহেরজান
০২.
আমি মেহেরজান বলছি। নাম শুনে তো আপনারা আনন্দিত ও পুলকিত হবেন কারণ ভাববেন আমি গওহরজান বা নগরজানের ঘরানার কেউ। দুঃখিত, তাদের সঙ্গে এ জীবনে আমার যোগাযোগের কোনও সূত্র ঘটে নি, তবে ঘটলেও আশ্চর্য হবার কিছু ছিল না। জীবনটা তো সরল সমান্তরালরেখায় সাজানো নয়। এর অধিকারী আমি সন্দেহ নেই, কিন্তু গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করেন –কি বললেন আল্লাহ্, পাগল হয়েছেন। বাঙালি মেয়ের জীবন পরিচালিত হবে আল্লাহর নির্দেশে! তাহলে এদেশের মৌলবী মওলানারা তো বেকার হয়ে থাকবেন, আর রাজনীতিবিদরাই-বা চেঁচাবেন কি উপলক্ষ করে? না এসব আমার নিজস্ব মতামত, অভিযোগের বাধা আটি নয়।
আমি নিজে সচেতন ও দৃঢ় বিশ্বাসী যে আমি একজন বীরাঙ্গনা। আমার রাষ্ট্র আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, আমার পিতামাতা হাত বাড়িয়ে আমাকে বুকে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সমাজের জুলুমবাজির ভয়ে আমি তাদের ঘরে যেতে পারি নি। তবে আপনারা বিশ্বাস করতে পারেন আপনাদের দৃষ্টিতে আমি বীরাঙ্গনা না হলেও নিঃসন্দেহে বারাঙ্গনা নই। এ কথা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি যে সব কিছুর ওপরে আমি একজন অঙ্গনা। পুরুষের লালাসিক্ত জান্তব দৃষ্টি আমি দেখেছি, ভর্ৎসনা অত্যাচার সয়েছি আর তাতেই জীবনের দীর্ঘ আটমাস আমি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেছি, উপলব্ধি করেছি, আমি অঙ্গনা এই-বা কম কি? নারীজন্ম তো কম কথা নয়, আমরা জীবন সৃষ্টি করতে পারি, স্তন্য দানের ক্ষমতা আমাদের আছে! দশমাস গর্ভে ধারণের পরও লালন পালনের দায়িত্ব আমাদের। আমিও তাই এক সন্তানের জননী। নাই-বা পেলাম স্বামীর সোহাগ, সুখের সংসার তবুও তো নিজের পায়ে সম্মানের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি।
যেভাবে এখন আপনাদের কাছে কথা বলছি আমি কিন্তু ওরকম অহংকারী নই। আসলে নিজেকে তো প্রকাশ করবার সুযোগ সুবিধা পাই নি, মাথাটা নিচু করেই সবার দৃষ্টি বাঁচিয়ে সংসারে ন্যূনতম স্থান অধিকার করেই কোনও মতে টিকে ছিলাম। কিন্তু আমার মাতৃতুল্য এক মহিলার মুখে শুনলাম আমি একজন মহিয়সী নারী। জোয়ান অব আর্কের মতো দেহে না দিলেও আমার শ্রেষ্ঠ সম্পদ নারীত্ব আমি দেশের জন্য উৎসর্গ করেছি। তবুও কোনো মিনারে আমাদের নাম কেউ খোদাই করেনি। সম্ভবত লজ্জায়। কারণ রক্ষা তো করতে পারে নি আমাকে সর্বনাশের হাত থেকে, হাততালি দেবে কোন মুখে? আমার অবস্থানের জন্য আমি উপেক্ষিত হয়েছি নির্মম নিষ্ঠুরভাবে কিন্তু জানি না কোন ঐশ্বরিক শক্তির বলে আমিও কখনও মাথা নোয়াই নি।