বাবাকে আগেই বলেছি আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে না। কারণ আমাকে আনতে যাবার কারণ স্পষ্ট, কিন্তু দিয়ে আসাটা আমি সহ্য করতে পারবো না। নিয়েল স্থানীয় প্রেসক্লাবেই সময় কাটালো, তবে তার মুখ দেখে বুঝলাম ও ওর প্রত্যাশিত সংবাদ বা ইতি মন মানসিকতা খুঁজে পায় নি।
আসবার আগে দাদা এবং বাচ্চারা স্টেশনে এলো। বাবা আর মা গেটের বেড়া ধরে দাঁড়ানো। প্রণাম করতেই বাবা শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। শুধু অস্পষ্ট উচ্চারিত একটি শব্দই আমার বোধগম্য হলো। বাবা আমার কাছে ক্ষমা চাইছেন, কিন্তু কেন? বাবার কি আর কিছু করবার ছিল? সেদিনের বাঙালি-দেহে স্বাধীন হলেও মনটাকে তো পরিচ্ছন্ন করেতে পারে নি। কই একজন বীরাঙ্গনার খোঁজ তো আমি অর্ধবিশ্ব প্রদক্ষিণ করেও পাই নি। ছিঃ ছিঃ ধিক্কার দিলাম আমি নিজেকে নয়, বাঙালির জরাব্যাধিগ্রস্ত সামাজিক ন্যায়নীতি বোধকে। ওদের কাছে মানুষের চেয়ে প্রথা বড়!
মা জড়িয়ে ধরে হাতে কি যেন একটা গুঁজে দিলেন, বললেন, টমাসের বউকে দিস, বলিস ওর দিদিমা দিয়েছে। মুঠি খুলতে দিলেন না। বললাম মা, এখুনি কেন, আমি আবার আসবো। বললেন–এসো, তবে তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। তোমাকে দেখবার জন্যই প্রাণটুকু বেরিয়ে যায় নি। দেরি হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত এগিয়ে গেলাম গাড়ির দিকে। বাঁক ফিরতেই হারিয়ে গেলেন বাবা-মা, আমাদের বাড়িঘর, আমার শৈশবের লীলাভূমি তারুণ্যের স্বপ্নসাধ ঘেরা জন্মস্থান। কিন্তু কেন যেন আর ভাবতে পারছি না। সারাটা পথ টমাস শুধু আমাদের দুজনকে ক্রমাগত বিরক্ত করে গেল। কেন আমরা ফিরে যাচ্ছি, কোপেনহেগেন কেন? কেন দাদুর বাড়ি থাকছি না, ইত্যাদি। নিয়ে শুধু সান্ত্বনার স্বরে বললো, তারা মন খারাপ করে না, আমরা আবার আসবো। আমি শুধু জানি, আসবার জন্য তারা ব্যানার্জী কাঁদবে, কিন্তু মিসেস টি. নিয়েলসেন নাড়ির বন্ধন কেটেই এবার ফিরে যাচ্ছে? কেন একথা ভাবলাম বলছি তোমাকে আপা।
ফিরে এসে ভেবেছিলাম খুব মন খারাপ হবে কিন্তু সামলে নিলাম। শুধু ফিরবার পথে ট্রেনে হাতের মুঠি খুলে দেখলাম মা তার গলার হার দিয়েছেন তাঁর নাতি টমাসের বউয়ের জন্য। জন্ম থেকে এ হার মায়ের গলায় দেখেছি। ভাবি, সত্যিই কার্যকারণ দিয়ে মানুষের মনকে বিচার করা যায় না। কোথায় জন্মেছে টমাস আর কোথা থেকে এলো তার এই দিদিমা! জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু উপহার রেখে গেল মা এই পালক নাতির জন্য, অবশ্য টমাসের প্রকৃত পরিচয় আমার পরিবার কেন, আমাদের পরিচিতরাও অনেকেই জানেন না।
কিছুদিন পর নোরার জন্ম হলো। আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে তোরা মনে হয় যাদু করলো। ওরা মাঝে মধ্যে শুক্রবার বিকেলে আসতেন আর রবিবার ডিনার শেষে যেতেন। অবশ্য পরে নোরাই শুক্র-সোম করতো দাদা দাদির বাড়িতে।
তোমার তো এখন পরিপূর্ণ স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, আদর, ভালোবাসা, কর্মক্ষেত্রের সাফল্য, যশ, খ্যাতি। তোমার তো আর কিছুরই অভাব নেই। তুমি সব ভুলে নিজেকে এখন সম্পূর্ণ একজন সুখী ও সার্থক নারী বলে ভাবতে পারো। এখন তোমার কিসের অভাব ও অস্বস্তি তারা? গভীর আগ্রহে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
গভীর রাতের তারাভরা আকাশের দিকে চেয়ে তারা যেন হারিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সন্বিৎ ফিরে পেয়ে বললো আপা দেশ স্বাধীন হয়েছে, কেউ গাজী-কেউ শহীদ। কেউ বীরউত্তম,বীরশ্রেষ্ঠ, কেউ মন্ত্রী, কেউ রাষ্ট্রদূত সবার কতো সম্মান সুখ্যাতি। আর আমি? আমি কিছু চাই নি, চেয়েছিলাম শুধু আমার নারীত্বের মর্যাদা আর প্রিয় জন্মভূমির বুকে আশ্রয়। স্বদেশে আমার সত্যিকার পরিচয় নেই, তারা ব্যানার্জী মরে গেছে। সেখানে সেদিন সম্মান মর্যাদা সবই পেলো মিসেস টি. নিয়েলসেন আর টমাসের মা। আমি কোথায়? ওদের কাছে আমি ঘূণ্য, নিন্দিত, মূত।
আর বাংলার মাটি–তাকেও তো আমি হারিয়েছি। আমি আজ ডেনমার্কের নাগরিক। আমাকে তো কেউ বাঙালি বলবে না। তোমার কাছেও তো আমার দু’বছর লাগলো নিজের পরিচয় তুলে ধরতে। আমার এ সংকোচ, এ লজ্জাবোধ কেন বলতে পারো? সমগ্র জীবনে আমার চলার পথে অপরাধটা কোথায়? যে বাবা, ভাই আমাকে দুবৃত্তের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে নি তারাই বিচারকের আসনে বসে আমাকে অপবিত্র অশুচি জ্ঞানে পরিত্যাগ করলেন। কি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা ভাবলে ঘৃণা হয়। আর যে আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন সে এক ছদ্মবেশধারী বিদেশিনী। আপা আমি যখন ছোট্ট ছিলাম তখন আমাদের বাড়ির পাশে একজন সরকারি উকিল ছিলেন। প্রায়ই দেখতাম সুন্দর এক তরুণী সেজেগুজে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ও বাড়িতে আসতো। এদের বাড়ির মেয়ে মিলি ছিল আমার বন্ধু। কৌতূহলবশে একদিন জিজ্ঞেস করলাম মিলিকে ওই মহিলার কথা। মিলি বললো, ও তো বাবার মক্কেল শরীয়ত উল্লাহর বউ। ওকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল গুণ্ডারা। চার-পাঁচদিন পর ও. ফিরে এসেছে। ওর স্বামী তাই মামলা করেছে গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে।
এবার আমার অবাক হবার পালা। বললাম, ও থাকে কোথায়? কেন, ওর স্বামীর বাড়িতে। ওমা ওর স্বামী ওকে ঘরে নিলো? হ্যাঁ নিয়েছে। বউটা আমার মাকে বলেছে, জানেন মা, আমরা মুসলমান, আমাদের ধর্মে বাজারের মেয়ে বিয়ে করে আনা যায়। আমার স্বামী বলে, তোমাকে রক্ষা করতে না পেরে এক গুনাহ করেছি আবার ত্যাগ করবো? মরলে আল্লাহর কাছে আমার তো মুখ দেখাবার পথও থাকবে না।