ফিরবার পথে বাবা অনর্গল কথা বলে চলেছেন। একপাশে টমাস, এক পাশে দাদার ছেলে জয়। মনে হলো টমাসের নামকরণ যদি আমি করতাম তাহলে হয়তো জয় রাখতাম। মেয়ে হলে রাখবো জয়া। সেখানেও পরাস্ত হয়েছি। শাশুড়ি আগেই নাতনির নাম ঘোষণা করেছেন। তারার মেয়ে হবে নোরা, মায়ের মতোই দৃঢ়চেতা সংস্কারমুক্ত, তাঁর আবেগ ও যুক্তি কোনোটাকেই আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারি নি। আমি বাবার দিকে তাকিয়েই আছি। ট্রেন চলছে দ্রুত গতিতেই। বাবা টমাসের সঙ্গে কখনও বাংলা কখনও ইংরেজিতে কথা বলছেন। নিয়েল নিচু গলায় দাদার সঙ্গে আলাপ করছে। আমি দীর্ঘ দশ বছর পর ফিরে গেছি শৈশবে। মনটা এখন বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দাদা একটা বুদ্ধির কাজ করেছিল। বাড়িতে কাউকে জানায় নি আমরা কোন ট্রেনে আসবো। এটা দাদার আত্মরক্ষার প্রয়াস কিনা জানি না তবে অতিরিক্ত হৈ চৈ নিয়েল পছন্দ নাও করতে পারে।
খুব ধীর পায়ে গেট ঠেলে সবার আগেই ঢুকলাম। বাড়ির চেহারা পাল্টে গেছে। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের চিহ্ন বর্তমান। বাবা বাগানের যত্ন বাড়িয়েছে মনে হয়। তেমনই বেড়ার গা দিয়ে সারিবদ্ধ রজনীগন্ধা আর দোলনচাপা। আর চাইতে পারলাম না। চোখের জলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল। গাড়ির শব্দ পেয়ে মা বেরিয়ে এলেন। প্রণাম করবার জন্য মাথা নিচু করতেই মা সন্তানহারা জননীর মতো আর্তনাদ করে উঠলেন। মাকে টেনে ভেতরে নিলাম। নিয়েলও আমার মতো নিচু হয়ে মায়ের পা ছুঁতে গেল। মা জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বেঁচে থাকো বাবা। এরপর সবটুকু যত্ন, ভালোবাসা, আদর সোহাগ পেলো টমাস। মা বললেন টমাস তার বাবা-মা কারও মতো হয় নি। হয়েছে তার দাদুর মতো অর্থাৎ আমার বাবার মতো। হবে না কেন রক্তের ধারা বইছে না! ওদের আনন্দ গর্ব নিয়ে ওরা থাকুক, এর থেকে ওদের বঞ্চিত করবো না। বউদি সম্ভবত আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হবে। মুখখানা মিষ্টি। এবার মুখ-হাত ধুয়ে ব্যাগ খুলে যার জন্য যা এনেছি সব বের করলাম। সবাই খুশি।
পাড়ায় খবর রটে গেল। বাড়ি প্রায় ভরে উঠলো। নিয়েল সবার সঙ্গে হাত মেলালো কেমন আছেন, ভালো ইতাদি বলে অসংখ্য হাততালি পেলো। দাদাকে ডেকে বললাম নিয়েলের জন্য স্থানীয় কোনও রেস্টহাউজ বা হোটেলে দু’দিনের জন্যে ব্যবস্থা করে দিতে। ওর সত্যিই কষ্ট হচ্ছে। দাদা বুঝলো, ঘন্টাখানেকের ভেতর নিয়েল ও ছোট পিঠ ব্যাগটা নিয়ে চলে গেল। ভুললে চলবে না ও সাংবাদিক। শহর ঘুরে পঁচজনের সঙ্গে কথা না বলে ওর শান্তি হবে না। টমাসের টিকিটিও দেখছি না। মনে হয় বাড়ির চৌহদ্দির ভেতরেও নেই।
বউদি মাঝে মাঝে চায়ের কথা জিজ্ঞেস করছে। গরমে আমার প্রাণ বেরুচ্ছে। মা আমাকে ওপরে নিয়ে এলেন। বললেন, শুধু শুধু জামাইকে হোটেলে পাঠালি এই দেখ তোদের জন্য ঘর গুছিয়ে রেখেছি। সঙ্গে রাথরুমও আছে। হঠাৎ মনে পড়লো বাবা বলেছিলেন সরকারি সাহায্য পেয়েছেন। তাই দিয়ে ওপরে ঘর তুলেছেন। আমার নারীত্বের মূল্য এই ঘর! আমার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। কিন্তু না, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি অতীতকে কখনও আর সামনে আনবো না। ঠিক আছে এতোবড় মূল্য যখন দেশের মুক্তির জন্যে দিয়েছি তখন অভাবগ্রস্ত পিতা না হয় একটু স্বাচ্ছন্দ্য পেলেন। আজ মনে হচ্ছে গৃহদাহের অচলার বাবা কেদার বাবুর কথা। আমি তোমাদের সবাইকে ক্ষমা করেছি-মহিম, অচলা, সুরেশ, বৃক্ষলতা, পশু-পক্ষী সবাইকে। আমিও, হ্যাঁ আমিও, তাই করলাম মা। মা হঠাৎ ঘুরে বললেন কিরে ডাকলি কেন? বললাম না তো, এমনিই মাঝে মাঝে তোমাকে ডাকি। ঘরে বসিয়ে মায়ের কো কথা। জামাই কি ওসব জানে। বললাম, তুমি ভেবোনা মা। তোমার জামাই, তার-বাবা-মা-আত্মীয়স্বজন সবাই জানে। সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে আর সম্মান করে। ওরা অনেক বড়, অনেক উদার তা না হলে এমন স্বভাব হয়, মা নিশ্চিত হলেন।
সন্ধ্যাবেলায় দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোদের সেই মকবুল চেয়ারম্যানের খবর কি রে? নিয়েল একবার ওর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। ও তো নেই ‘৭২-এর ১৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা ওকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। একটা বড় করে নিশ্বাস নিলাম। কিছু প্রতিকার হয়েছে তাহলে। দাদা ভারাক্রান্ত গলায় বললো, কিন্তু হলে কি হবে, ওর ছেলেটা এখনই বাবার পথ ধরেছে। এখন তো রাজাকার পুনর্বাসন চলছে, ও লাইন দিয়েছে। হয়তো-বা কিছুদিনের মধ্যে মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী হয়ে যাবে।
না, আমি নির্বাসিত হলেও রাজাকার আলবদর নির্বাসিত হয় নি। বরং আমাদের উপর অত্যাচার চালাবার জন্য পুরস্কার পেয়েছে ও পাচ্ছে। তবে দেশের অবস্থা কিন্তু খারাপ মনে হলো না। বিশেষ করে পথে-ঘাটে-দোকানে-বাজারে অনেক মেয়ে ও মহিলা দেখলাম, যা ‘৭১-এর আগে চোখে পড়ে নি। দাদা বললেন ত্রিশলক্ষ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হওয়ায় অনেক পরিবারের মহিলাদের পথে বেরুতে হয়েছে উপার্জনের তাগিদে, বাচবার আশায়। ভাবলাম মুক্তিযুদ্ধ নারীমুক্তি সহজ করেছে কিন্তু পুরুষেরা মনে হয় আরও বীর্যহীন পৌরুষহীন হয়ে পড়েছে, নইলে রাজাকার আলবদর মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী? তারার মনে হয় বিশ্বপৌরুষ যেন আজ নারীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় থেমে যাচ্ছে। সময় স্বপ্নের মতো কেটে গেল। নিয়েল উপভোগ করলো আর টমাসের তো কথাই নেই। পাটালি গুড়ের আমসত্ত্ব থেকে শুরু করে আমড়া, চালতা পর্যন্ত ভক্ষণ করা হয়েছে ওর। সারাদিন পুকুর, বাগান, মায়ের পূজোর ঘর, রান্নাঘর করে বেড়ালো। এক নতুন জগৎ দেখে গেল।