নিয়েলের ভালোবাসা ওদের স্নেহ-মমতা আমার অতীতকাল মুছে ফেললো। আশি সালে নিয়েল হঠাৎ প্রস্তাব দিলো ও একটি ছেলে দত্তক নিতে চায় যদি আমার সম্মতি থাকে। সমাজকল্যাণ দপ্তরে দরখাস্ত, হাঁটাহাঁটি অনেক চেষ্টা চরিত্র করে টমাসকে পেলাম। ও আইরিশ। গৃহযুদ্ধে বোমা পড়ে ওর বাবা-মা নিহত হয়। কেমন করে ও ডেনমার্কে এসেছে আমি ঠিক জানি না। তবে ওর মা ওকে হাসপাতালে দেখে নিয়েলকে জানান। কারণ ওকে এ বয়সে দত্তক দেবে না। ওখানে ইচ্ছে করলেই কিন্তু দত্তক নেওয়া যায় না। বিবাহিত দম্পতি এক সঙ্গে থাকতে হবে, বাচ্চা মানুষ করার মতো আর্থিক সঙ্গতি থাকতে হবে, উপযুক্ত লোকের দেওয়া চরিত্র সম্পর্কিত প্রশংসাপও লাগবে। সবই হলো। আমরা টমাসকে দত্তক নেবার মতো সক্ষম দম্পতি বলে বিবেচ্য হলাম। টমাসকে পেয়ে নিয়েল মহাখুশি। আমি একটি মেয়ে প্রত্যাশা করেছিলাম। ওকে সাজাবো, আদর করবো, মনের মতো করে বড় করবো। আমার শাশুড়ি তো মুখ ফুলিয়ে রইলেন। যাক কয়েক ঘন্টার ভেতর টমাস আমাদের ব্যস্ত করে তুললো। বার বার নিয়েলকে বাইরে যেতে হলো ওর প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনতে। আমার সমস্যা ছিল ভাষার ব্যবধান। পরদিন ওকে নিয়ে খেলনার দোকানে গেলাম তারপর চকোলেট কিনতে। মুহূর্তে আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। দু’বছর পর নিয়ে একটা আমন্ত্রণ পেলো দিল্লী থেকে। আমাকেও সঙ্গে নিতে চাইল টমাসসহ। রাজি হলাম। আমাকে দেখলে কেউ চিনতে পারবে না। আমি তো স্কার্ট ব্লাউজ অথবা জিনস্ পরি, চেহারাও বদলে গেছে। ঠিক করলাম যাবো।
১৯৮২ সালে দিল্লীতে এলাম। সমস্ত ইন্দ্রিয় নিয়ে যেন দেশের আকাশ-বাতাস স্পর্শ করলাম। হোটেল অশোকা নির্ধারিত ছিল। এসে উঠলাম। নিয়েলের একটা মিটিং ছিল সন্ধ্যা ছ’টায় ঐ হোটেলের লাউঞ্জে। আমি কলকাতায় দিদিকে ফোন করলাম। বললাম স্বামীর সঙ্গে এসেছি ছেলেকে নিয়ে। সায়েব বিয়ে করেছি শুনে দৌড়ে জামাইবাবুকে ডেকে আনলো। জামাইবাবু মনে হয় ফোনের ভেতর দিয়েই আমাকে টেনে নেবেন! বললাম তিনদিন নিয়েলের কনফারেন্স তারপর কলকাতা যাবে। যাবার আগে ফ্লাইট নাম্বার জানিয়ে ফোন করতে বললো। আমি নিয়েলকে সব বললাম। নিয়েল খুব খুশি হলো। বললো এবার বাঙালি জামাই হয়ে শ্বশুর বাড়ি যাবে। নিয়েল ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারে। টমাস ইংরেজি গোটা কয়েক শব্দ জানে। তার বেশি এখনও আয়ত্ব করতে পারে নি।
দিল্লী থেকে দিদির জন্য শাড়ি আর জামাইবাবুর জন্য শাল কিনলাম। বাবার জন্যেও একখানা শাদা শাল কিনতে চাইলাম কিন্তু না যদি ও পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারি তাহলে একটি বাড়তি দুঃখ থেকে যাবে। বাচ্চারা ক’জন কতো বড় হয়েছে জানি না। থাক, কলকাতায় কতো কিছু পাওয়া যায়। এই দিদিকেই পোল্যান্ড থেকে ফোন করেছিলাম। দিদি ছিঃ বলে ফোন ছেড়ে দিয়েছিল। না, আমার অতীত মৃত। আমি বর্তমান মিসেস টি নিয়েলসেন।
দিদি, জামাইবাবু ঠিকই এয়ারপোর্ট এসেছেন। দিদি বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। আমার চোখে এখন আর জল আসে না। সব ঋরে ভাণ্ডার শুকনো হয়ে গেছে মনে হয়। সোজা ওদের বাসায় গিয়ে উঠলাম ভবানীপুরে। ফ্ল্যাটটা মোটামুটি মন্দ না। আমরা অবশ্য হোটেলেই থাকবো দিল্লী থেকে বুকিং করে এসেছি। হোটেল পার্ক স্ট্রীটে। চা খেয়ে দিদিকে বললাম সে কথা। দিদি কিছুতেই শুনতে চায় না। জামাইবাবু বুঝলেন। বললো, ওরা ক্লান্ত, যাক মুখ-হাত ধুয়ে স্নান সেরে এসে রাতে এখানে খাবে আবার সকালে উঠেই চলে আসবে। রাগ হলো। দিদি পাশের ঘরে টেনে নিয়ে বললো, তুই ভাগ্যবতী, বড় সুন্দর জামাই হয়েছে তোর। আর ছেলেটাও যেন কার্তিক। হারে রাজশাহী যাবি না। আমি কেঁপে উঠলাম। বললো, কাল বাবাকে ফোন করেছিলাম। বাবা-মা দুজনেই বারবার করে তোদের যেতে বলেছেন। কোনও অসুবিধে হবে না। জামাই মনে মনে হাসলেন কার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে যে কিছু বলবে। বাবার নাম্বার নিলাম ওর কাছ থেকে। ভাবলাম নিজেই ফোন করে সঠিক অবস্থা জেনে নেবো। যে লাঞ্ছনার জীবন পেছনে ফেলে এসেছি, স্বামী-সন্তান নিয়ে সে কালি আর গায়ে মাখবো না।
পরদিন সকালে বাবাকে ফোনে পেলাম। বাবা হাউ মাউ করে শিশুর মতো কেঁদে উঠলেন। শুধু বারবার বলতে লাগলেন মাগো, আমায় ক্ষমা কর। বললাম আগামী পরশু ঢাকা যাবো। তুমি কষ্ট করে ঢাকায় এসো না, আমি ঢাকা পৌঁছে ফোন করবো। মাকে ফোন দিতে বললাম মার গলা পেলাম,শুধু মা মা করে কয়েকবার ডাকলেন এবং ডুকরে কেঁদে উঠলেন! নিয়েলকে সব বললাম। ও অবশ্য আগেই ঢাকায় প্রোগ্রাম করে রেখেছিল কারণ ‘৭১ সালের পর ও আর ঢাকায় যায় নি। তাই ও আনন্দে রাজি হয়ে গেল। এয়ারপোর্টে বাবা, দাদা আর ওর এগারো বছরের ছেলে জয় উপস্থিত ছিল। এতো সাদর অভ্যর্থনার পরও দাদার শ্বশুরবাড়িতে উঠতে রাজি হলাম না। হোটেল বুকিং নিয়েল আগেই করে এসেছিল। তাই সবাই শেরাটনে গেলাম, খাওয়া দাওয়া সেরে বাবাকে চলে যেতে বললাম। আমরা কদিন ঢাকা থেকে যাবো। বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না, বললেন একা ফিরে গেলে মা তাকে বাড়ি ঢুকতে দেবেন না। অবশ্য কিছুক্ষণের জন্য ওরা চলে গেলে আমরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে সাভার গেলাম জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে, ফিরে এসে বত্রিশ নম্বরের সামনে দাঁড়ালাম। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ফিরে এসেছেন। পুলিশ পাহারা আছে, তবে ঢুকতে দেয়। ভাবলাম ফিরে যাবার পথে নিয়েল অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেই এ বাড়িতে আসবে, তখন আমিও অনুমতি পাবো ঢুকবার জন্য। টমাসকেও দেখানো দরকার। আমি কখনও ভুলি না ও ডি ভ্যালেরার দেশের ছেলে। জিদ্দীও হয়েছে খুব। গেটের সামনে থেকে কিছুটা ধুলা তুলে নিজের ও টমাসের কপালে মাখালাম। নিয়েল নিজেই নিজের কপালে ধুলো ছোঁয়ালো। ও বঙ্গবন্ধুকে দেখেছে, কথা বলেছে। তাই ও যথেষ্ট আবেগতাড়িত ছিল। শ্রান্ত ক্লান্ত অবসন্ন দেহে ফিরে এসে যাত্রার প্রস্তুতি নিলাম। এবার রাজশাহী পর্ব। আমার জীবনের সর্বকঠিন অগ্নিপরীক্ষা।