- বইয়ের নামঃ আমি বীরাঙ্গনা বলছি
- লেখকের নামঃ নীলিমা ইব্রাহিম
- প্রকাশনাঃ জাগৃতি প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ মুক্তিযুদ্ধের-বই
১. মনুষ্যসমাজ কত বিচিত্র
অখণ্ড সংস্করণের ভূমিকা
আমি পাঠক সমাজের কাছে ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ড প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। কিন্তু দুটি কারণে এ প্রচেষ্টা থেকে বিরত রইলাম। প্রথমত, শারীরিক কারণ বীরাঙ্গনাদের নিয়ে লিখতে গিয়ে আমার হৃদয় ও মস্তিষ্কের উপর প্রচুর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং নতুন করে আর এ অন্ধকার গুহায় প্রবেশ করতে পারলাম না। দ্বিতীয়ত, বর্তমান সমাজের রক্ষণশীল মনোভাব। বর্তমান সমাজ ‘৭২ এর সমাজের চেয়ে এদিকে অধিকতর রক্ষণশীল। বীরাঙ্গনাদের পাপী বলতেও তারা দ্বিধাবোধ করেন না। সুতরাং পঁচিশ বছর আগে যে-সহজ স্বাভাবিক জীবন থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁদের নতুন করে অপমানিত করতে আমি সংকোচ বোধ করছি।
উপরন্তু অনেক সহৃদয় উৎসুক ব্যক্তি এঁদের নাম, ঠিকানা জানার জন্য আমাকে যথেষ্ট পরিমাণে বিব্রত করেছেন। আমার ধারণা একদিন যাদের অবহেলাভরে সমাজচ্যুত করেছি, আজ আবার নতুন করে তাঁদের কাটাঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে, নতুন করে তাঁদের বেদনার্ত ও অপমানিত করা ঠিক হবে না। এ কারণে তৃতীয় খণ্ড প্রকাশে আমি অক্ষম। আমি আপনাদের মার্জনা ভিক্ষে করছি। সম্প্রতি আমার তরুণ প্রকাশক দীপন প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড নিয়ে ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ গ্রন্থের অখণ্ড সংস্করণ প্রকাশ করতে যাচ্ছেন। আমি তার এ সাধু-প্রচেষ্টার জন্য আরেকবার ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আর আমার সহৃদয় পাঠকের প্রতি বীরাঙ্গনাদের পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জ্ঞাপন করছি।
নীলিমা ইব্রাহিম
তারিখ। ১০.১২.৯৭
.
ভূমিকা
১৯৭২ সালে যুদ্ধজয়ের পর যখন পাকিস্তানি বন্দিরা ভারতের উদ্দেশ্যে এ ভূখণ্ড ত্যাগ করে, তখন আমি জানতে পারি প্রায় ত্রিশ-চল্লিশজন ধর্ষিত নারী এ বন্দিদের সঙ্গে দেশ ত্যাগ করছেন। অবিলম্বে আমি ভারতীয় দূতাবাসের সামরিক অফিসার ব্রিগেডিয়ার অশোক ডোরা এবং বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে নিয়োজিত মরহুম নুরুল মোমেন খান যাকে আমরা মিহির নামে জানতাম তাঁদের শরণাপন্ন হই। উভয়েই একান্ত সহানুভূতির মনোভাব নিয়ে এসব মেয়েদের সাক্ষাৎকার নেবার সুযোগ আমাদের করে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নওসাবা শরাফী, ড. শরীফা খাতুন ও আমি সেনানিবাসে যাই এবং মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা লাভ করি।
পরে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত থেকে নারকীয় বর্বরতার কাহিনী। জানতে পারি। সেই থেকে বীরাঙ্গনাদের সম্পর্কে আমার আগ্রহ জন্মে। নানা সময়ে দিনপঞ্জিতে এঁদের কথা লিখে রেখেছিলাম। ইচ্ছা ছিল, জনসমাজে এঁদের পরিচয় তুলে ধরার। এ ক্ষুদ্র গ্রন্থ সে আগ্রহেরই প্রকাশ।
এখানে একটি কথা অবশ্য উল্লেখ্য। চরিত্রগুলি ও তাদের মন মানসিকতা, নিপীড়ন, নির্যাতন সবই বস্তুনিষ্ঠ। তবুও অনুরোধ অতি কৌতূহলী হয়ে ওদের খুঁজতে চেষ্টা করবেন না। এ স্পর্শকাতরতা আমাদের অবহেলা এবং ঘৃণা ও ধিক্কারের দান।
‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি অনেক দিন ধরেই প্রস্তুত করছিলাম। প্রকাশে শঙ্কা ছিল। কিন্তু আমার স্নেহভাজনীয় ছাত্রী কল্যাণীয়া বেবী মওদুদ উৎসাহ, প্রেরণা ও তার অদম্য কর্মক্ষমতা নিয়ে এগিয়ে এলেন।
১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারির বইমেলার জন্য ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ ১ম খণ্ডের পাণ্ডুলিপি ভীত কম্পিত হস্তে, সংশয় শঙ্কাকূল চিত্তে প্রকাশকের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু না, প্রজন্ম একার এই দেশপ্রেমিক রমণীদের মাতৃসম্মানে সমাদৃত করেছে। তারা আরও জানতে চেয়েছে সেই সাহসী বীরাঙ্গনাদের কথা। তাই সাহসে ভর করে এগুলাম। অনেকে সংবর্ধনা ও সম্মান জানাবার জন্য এদের ঠিকানা চেয়েছেন। তার জন্য আরও একযুগ অপেক্ষা করতে হবে।
যদি জীবনে সময় ও সুযোগ পাই তৃতীয় খণ্ড প্রকাশের বাসনা রইল ধর্মান্ধতার কালিমা দূরীভূত করতে। আমার প্রকাশকের সঙ্গে অগণিত পাঠকের প্রতি রইলো সকৃতজ্ঞ শুভেচ্ছা।
নীলিমা ইব্রাহিম
তারিখ। ১৭.০১.৯৪
.
০১.
প্রকৃতির মতো মনুষ্যসমাজও কত বিচিত্র। প্রকৃতিতে কোথায়ও সমভূমি ধূসর সুজলা সুফলা আবার কোথায়ও বারি বিন্দুহীন মরুভূমি। একদিকে সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নাগাধিরাজ হিমালয় পর্বত আর নিয়ে বয়ে চলেছে মহাসমুদ্র। কোথায়ও জ্যৈষ্ঠর দাবদাহ, কোথায়ও-বা হিম প্রস্রবণ বা তুষারপাত।
একা একা বসে যখন ভাবি আমার জীবনটাও তো এমনি! প্রকৃতির বৈচিত্র্যের মতো স্নেহ, প্রেম, ভালোবাসা, ঘৃণা, লজ্জা, রোষ, করুণার সমাহার। এ জীবনে সব কিছুরই স্পর্শ আমি পেয়েছি। কখনও মৃদু কোমল স্পর্শ বা আঘাত আবার কখনো অশনি পতনের দাবদাহ। সেকথা, আমার সে অনুভূতির গভীরতাকে কখনও দ্বিতীয় ব্যক্তির শ্রবণগোচর করবো এমন সাহস আমার ছিল না। কারণ এ সাহস প্রকাশের শিক্ষা শৈশব থেকে কখনও পেয়ে আসি নি। নামতা পড়ার মতো শুধু আউড়িয়েছি আমি মেয়ে, আমাকে সব সইতে হবে। আমি হবো ধরিত্রীর মতো সর্বংসহা। প্রতিবাদের একটিই পথ, সীতার মতো অগ্নিপরীক্ষা বা পাতাল প্রবেশ। সীতা ছিলেন দেবী। তাই ও দু’টোর কোনোটারই সদ্ব্যবহার আমি করতে পারি নি! যখন চারিদিকে শুধু ছিঃ ছিঃ-ধ্বনি শুনেছি, সমাজপতি এবং অতি আপনজন বলেছেন, ‘মরতে পারলি হতভাগী, আমাদের মারবার জন্য এই কালোমুখ নিয়ে ফিরে এসেছিস?’ তাদের মুখ ফুটে বলতে পারি নি, না মরতে আর পারলাম কই? তার পথও তো তোমরা করে দিলে না। বাঁচাবার জন্য হাত বাড়াও নি, মরবার পথেও তো সহায়তা করো নি। না সে কথা মুখে বলতে পেরেছো, না কাজে পরিণত করবার মতো সৎসাহস সেদিন তোমাদের ছিল, আজও নেই, ভবিষ্যতের কথা ভবিতব্যই জানেন।