মিনিট পনেরো তর্কাতর্কি করে কুফুয়া ঘরের ভিতর এলো। একটা থ্রি নট থ্রি রাইফেল তুলে নিলো হাতে। শহীদকে বললো, আমি এই দরজার আড়ালে রইলাম, তুমি গিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে বাইরে দাঁড়াও। ভয় পেয়ো না, আমি রয়েছি পিছনে।
শহীদ তার কথামতো বাইরে এসে দাঁড়ালো। কি ব্যাপার সে কিছুই বুঝতে পারছে না। কুফুয়া এতো উত্তেজিত হয়েছে কেন?
জন দশ-বারো লোক এগিয়ে এলো শহীদের দিকে। তার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো ওরা। বিড়বিড় করে মিনিট দুয়েক তাদের নিজেদের ভাষায় কি মন্ত্র পড়লো। তারপর নিঃশব্দে ফিরে চললো তারা।
শহীদ বোকার মতো চেয়ে রইলো তাদের দিকে। কুফুয়া রাইফেল হাতে বেরিয়ে এলো বাইরে, তারপর আচমকা গুলি ছুড়লো লোকগুলোর ওপর। একটা, দুইটা, তিনটা এমনি করে ছটা গুলিতে দুজন লোককে মাটিতে ফেললো সে। ভীষণ চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো তারা। কুফুয়া এদিকে রাইফেলের ম্যাগাজিন খুলে ফেলেছে। শহীদকে বললো, রিভলভার ছোঁড়, আমি ততক্ষণে গুলি ভরে নিই।
ব্যাপারটা এতো আচমকা ঘটে গেল যে শহীদের বুদ্ধি সম্পূর্ণ লোপ পাওয়ার উপক্রম হলো। এটুকু সে বুঝেছে, ব্যাপারটা নিশ্চয়ই গুরুতর, নইলে কুফুয়ার মতো স্থিরমস্তিষ্ক মানুষ শুধু শুধু খুন খারাপি করতে পারে না। শহীদ দ্রুত চিন্তা করছে। এই বিদেশে এসে মানুষ খুন করে জেল খাটবে নাকি শেষ পর্যন্ত?
কিন্তু চিন্তা করবার আর সময় নেই। শহীদ দেখলো বাকি চার-পাঁচজন নিগ্রোর একজন সংবিত ফিরে পেয়ে পিস্তল বের করেছে। ব্যাপারটা প্রথম তারা বুঝতে পারেনি। চোখের সামনে ছজন সাথীর লাশ দেখে হঠাৎ ওরা রুখে দাঁড়ালো। কুফুয়ার দিকে নিশানা করেছে পিস্তলধারী। গুলি করলো শহীদ। তার গুলি পিস্তলধারীর কপাল ফুটো করে ঢুকে গেল মগজের মধ্যে। অদ্ভুত একটু গোঙানি তুলে লুটিয়ে পড়লো লোকটা। কুফুয়ার ততক্ষণে গুলি ভরা হয়ে গেছে। চোখের নিমেষে বাকি চারজন চিৎকার করে ধরাশায়ী হলো। শহীদ আর কুফুয়া এগিয়ে গেল লাশগুলোর দিকে। একজন তখনও একটু একটু নড়ছিল। রাইফেলের আগাটা তার কপালে ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপে দিলো কুফুয়া, ব্যাস খতম। রক্তে মাটিটা লাল হয়ে গেছে।
চোখের সামনে এগারোটা মৃতদেহ পড়ে আছে। লোকগুলোকে তারাই খুন করেছে। অথচ কারণ জানে না শহীদ এই নির্মম হত্যার। গা-টা গুলিয়ে আসে শহীদের, কেমন একটু বমি বমি লাগে অতো রক্ত দেখে।
হঠাৎ দূরে অনেকগুলো আলো দেখা গেল। অনেক লোক যেন কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে। বোধকরি গুলির আওয়াজ আর লোকগুলোর আর্তনাদ শুনতে পেয়ে লোকজন আসছে খবর নিতে। কুফুয়া রাইফেলের ওপর ভর দিয়ে একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে রইলো।
এদিকে লোকগুলো ক্রমে এগিয়ে আসছে। শহীদ গিয়ে কুফুয়ার কাছে দাঁড়ালো। কুফুয়া গভীরভাবে কি যেন চিন্তা করছে। তার জামার আস্তিন ধরে একটু টান দিলো শহীদ। বললো, মানুষ এসে পড়ছে। কোনরকম অসুবিধা হবে না?
না। কুফুয়া তার দিকে কেমন অদ্ভুত করে তাকায়। শহীদ ভাবে, পাগল হয়ে গেল না তো ব্যাটা?
না, পাগল হয়নি। লোকগুলো এসে লাশ দেখেই খানিকটা পিছু হটে গেল। তারপর কুফুয়াকে দেখে অত্যন্ত নম্রভাবে কি যেন জিজ্ঞেস করলো। কুফুয় এগিয়ে গিয়ে বেশ অনেকক্ষণ ধরে তাদেরকে কিছু একটা বোঝালো। ওরা অদ্ভুত চোখে শহীদের দিকে তাকিয়ে দেখলো একবার, তারপর পটাপট লাশগুলো তুলে নিয়ে কুফুয়ার পিছন পিছন লিতে শুরু করলো। শহীদও চললো ওদের সাথে সাথে। একটা কুপের মধ্যে লাশগুলো ফেলে কুফুয়ার বাড়ি থেকে কোদাল এনে মাটি কাটা শুরু করলো তারা। মাটি চাপা দিয়ে কবর দিলো তারা লোকগুলোকে। রক্তের দাগ চেঁছে ফেলা হলো। তারপর সবাই কুফুয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
এতো বড় পৈশাচিক ব্যাপার অত্যন্ত অবলীলাক্রমে যেন ঘটে গেল। এতগুলো খুন হলো, তার জন্যে কোনও চাঞ্চল্য নেই এদের মধ্যে। যেন হরদমই এমন ব্যাপার দেখে আসছে তারা। এদেশে পুলিস নেই নাকি? আইন নেই কোনও? এতোই সোজা এখানে খুন করে গুম করে ফেলা? নাকি এই লোকগুলোর ওপর সবাই চটা? এই খুনের সাক্ষী যারা তাদের মধ্যে থেকে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করবে না তো? বড় অস্বস্তি লাগে শহীদের।
ঠিক এই সময় একটা ছায়ামূর্তি সরে গেল দূর থেকে। গাছের তলায় আবছা আলো-অন্ধকারেও শহীদ স্পষ্ট দেখলে একজন নিগ্রো রাস্তায় পড়েই দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। কুকুয়া বাড়ির দিকে হাটছে চিন্তিত মুখে। কিছু না বলে শহীদ তার পিছন পিছন চলতে লাগলো।
শহীদ ভাবছে, মহুয়ারা ফেরে না কেন এখনও?
৬.
এদিকে বিকেল বেলা কামাল, মহুয়া, গফুর আর কুফুয়ার এক মেয়ে পেণ্ডা জায়গাটা ঘুরে ফিরে দেখে আসতে গেছে। শহীদ সকালে বেশ খানিকটা ঘুরে এসেছিল, তাই ও আর গেল না। গফুরেরও যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো না, দিদিমণি যখন যাচ্ছে তখন সেও চললো ওদের পিছু পিছু!
জায়গাটা বেশ ছোটো। কিন্তু বহু লোকের বাস এখানে। কাঠের ব্যবসার মস্ত বড় একটা ঘাঁটি এই Gungunyanas Ford. কুফুয়ার বাড়ির দিকটা বেশ নির্জন কিন্তু আর একটু দক্ষিণে অনেক কুঁড়েঘর দেখা গেল পাশাপাশি। ঘরগুলো মাটির তৈরি। ওপরে খড় বা শনের ছাউনি। আলো-বাতাসের কোনো বন্দোবস্ত নেই বললেই চলে। ছোটো একটা গর্ত মতো জায়গা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢােকা হয়, দরজাও নেই একটা। মেয়েরা কেউ বাড়ির সামনে মাটি কোপাচ্ছে, ভুট্টার খেত নিড়াচ্ছে কেউ বা ছেলে কাঁখে নিয়ে রান্না চড়িয়েছে। সবাই কামালদের দেখে কাজ ফেলে রেখে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলো। অদ্ভুত সব কাপড়-চোপড় পরা এতগুলো মানুষ কোথেকে এলো রে বাবা!