অনেক চেষ্টা করেও এদের কি উদ্দেশ্য জানতে পারলো না শহীদ। কেন এরা এতদূর গেল? কেনই বা ফিরে এলো আবার ওদের সাথে? সবই শহীদের কাছে ঝাপসা লাগে।
দেখা যাক কি হয়, শহীদ ভাবে।
Gungunyanas Ford-এ পৌঁছলো শহীদরা খুব ভোরে। লিস্পোপোর স্রোতের উল্টো দিকে একশো মাইল লঞ্চে করে এসেছে তারা। লঞ্চ ঠিক বলা যায় না। মস্ত বড় একটা ক্যানো নৌকোয় এঞ্জিন বসানো। প্রচুর পরিমাণে তেল নিয়েছে তারা সাথে করে।
সেই নিগ্রোগুলো তাদের সাথে এক লঞ্চে আসতে চেয়েছিল। লঞ্চে জায়গা প্রচুর, শহীদের আপত্তি ছিলো না, বরং সুবিধাই হবে বলে মনে করেছিল। কিন্তু মহুয়া কিছুতেই রাজি হলো না। বাঘা, সেদিন রাতের সেই নিগ্রোর মুখ তার স্পষ্ট মনে আছে, সেই ভয়ঙ্কর লোককে নিয়ে আবার একই লঞ্চে এতদূর যাওয়া অসম্ভব।
শহীদ তাদের মানা করে দিয়েছে। ওরা একটা সাধারণ ক্যানো নিয়ে পিছন পিছন আসছে। Gungunyanas Ford-এ ওরা শহীদের সাথে দেখা করবে।
পথে অজস্র কুমীর দেখেছে তারা। কুমীরের ভয় অনেকটা কেটে গেছে মহুয়ার। জলে তো আছেই, ডাঙার ওপরও কিলবিল করেছে প্রচুর কুমীর। এতো বেশি যে মারতে ইচ্ছে করে না।
মাঝে মাঝে এঞ্জিনকে বিশ্রাম দেয়ার জন্যে পথে থেমেছে ওরা। হঠাৎ একদিন প্রচণ্ড জোরে কেঁপে উঠলো লঞ্চ। মহুয়া শহীদকে জড়িয়ে ধরলো। ড্রাইভার বললো কুমীর লেজের ঝাপটা মেরে লঞ্চ উল্টিয়ে ফেলবার চেষ্টা করছে।
কামাল লঞ্চের কিনারায় ছিলো। আরেকটু হলেই ছিটকে নদীতে পড়তো। এই নদীতে নাকি তিন সেকেণ্ড জলে পা ডুবিয়ে রাখলেই পায়ে টান পড়ে। আর সেখানে একটা জলজ্যান্ত মানুষ জলে পড়ে যাওয়া! চিন্তাও করা যায় না এরই নাম লিষ্পেপো, Crocodile River.
৫.
লঞ্চের হালের নিচের দিকটা লোহার। কারণ জিজ্ঞেস করায় ড্রাইভার বললো, কুমীরগুলো অনেক রকম বুদ্ধি খাটায়। যখন বড় বড় ক্যানো উলটিয়ে ফেলতে পারে না, তখন হাল ভেঙে ফেলে লেজের বাড়ি মেরে। ফলে স্রোতের মুখে নৌকা যেদিক খুশি সেদিকে চলে। পাড়ের সাথে ধাক্কা লেগে হয় নৌকা ভাঙে এবং লোকগুলো কুমীরের পেটে যায়, নয় তো কোথাও গিয়ে আটকে থাকে। দিনের পর দিন কুমীরেরা অপেক্ষা করে থাকে। কোনো নৌকা যদি ভাগ্যক্রমে এসে পড়ে তো বেঁচে গেল, নইলে ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে যখন লোকগুলো ডাঙায় নামার চেষ্টা করে তখন ধরে নিয়ে যায় নিজ নিজ গর্তের মধ্যে।
নদীর দুপাশে ঘন বন। দেখলে মনটা দমে যায়। কেমন যেন ভয় ভয় করে। কয়েকজন জংলী লোকও দেখেছে ওরা। পাড়ে দাঁড়িয়ে গুদের মুখ ভ্যাঙাচ্ছিল। দূরে একটা হরিণ নেমেছিল জল খেতে, এঞ্জিনের শব্দ শুনে হকচকিয়ে গেল এক মুহূর্তের জন্যে তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল গভীর অরণ্যে।
লঞ্চটা একজনই চালায়। ইংরেজ। যুবক। নাম জন ব্লাইদ। লঞ্চটা ওর নিজেরই। জন্ম এদেশেই। বাবা হয়তো এসেছিল ভাগ্য অন্বেষণে, সুবিধা পেয়ে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে। প্রকাণ্ড বড় শরীর মি. ব্লাইদের। যেমন লম্বা, তেমনি চওড়া। দেখলে খুব সাহসী বলে মনে হয় তাকে। তেমনই আবার ভদ্রও খুব। Gungunyanas Ford-এ পৌঁছে কুফুয়াকে সে-ই খবর দিতে গেছে।
আধঘন্টা খানেক পর মি. ব্লাইদের সঙ্গে একজন বৃদ্ধ নিগ্রোকে আসতে দেখা গেল। খুব লম্বা ছিলো লোকটা। এখন কিছুটা নুয়ে পড়েছে বয়সের ভারে। কাছে এলে হাতের পেশীর দিকে নজর গেল শহীদের। এখনও সতেজ। এই বয়সেও তার শরীরে যথেষ্ট শক্তি আছে।
শহীদ হ্যান্ডশেক করতে এগিয়ে যাচ্ছিলো। কুফুয়া জড়িয়ে ধরলো তাকে। একটু দূরে সরিয়ে আবার ভালো করে মুখ দেখলো। আবার জড়িয়ে ধরলো। Warm অভ্যর্থনার চোটে গরম হয়ে উঠলো শহীদ। মনে মনে ভাবছে সে, ম্যালা বিপদ রে বাবা!
এই রকম অবস্থায় কি করতে হয় বা বলতে হয় শহীদ বুঝতে পারলো না। এদের দেশের রীতিই বোধহয় এমন। আন্তরিকতার চাপে বুকের পাঁজর ভাঙার উপক্রম।
এতক্ষণে কথা বললো কুফুয়া, Shahid I suppose? Exactly like your father eh! (শহীদ না? একেবারে বাপের চেহারা পেয়েছে দেখছি!)
শহীদ একটা বিনয়ের হাসি দেবার চেষ্টা করলো। এদিকে তাকে ছেড়ে দিয়ে কুফুয়া এখন কামালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।-Youre Karnal, I guess. (আর তুমি বোধ হয় কামাল?)
Glad to meet you, Mr, Kufua, (আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম মি. কুফুয়া।)
what? Glad? I am simply overwhelmed. Any way. How have you enjoyed the journey? (আমি খুব খুশি হয়েছি। যাকগে, কেমন লাগলো যাত্রাটা।)
Oh, It was fine, (চমৎকার)।
প্রচুর পরিমাণে বকর বকর করলো কুফুয়া। তার সাথে ইসলাম খাঁ ও ইকবাল আহমেদের কি করে পরিচয় হলো, কি করে তারা কুমীর শিকার করেছিল, কেমন ভাবে। হঠাৎ ইকবাল আহমেদ কুমীরের খপ্পরে পড়লো, তা আবার অভিনয় করে দেখালো, সে কিসের কিসের ব্যবসা করে, মাসিক আয় কতো, তার আত্মীয়স্বজন কোথায় কে আছে, তাদের মধ্যে আবার কে কে মারা গেছে, কারা বেঁচে আছে, কারা শিগ্গিরই মারা যাবে, সব খবর শহীদদের জানতে আধঘন্টার বেশি লাগলো না। পনেরো ষােল বছর আগে থেকে আজ পর্যন্ত কি কি ঘটনা ঘটেছে সবই সবিস্তারে গড় গড় করে বললো সে। অন্য কাউকে কিছুই বলতে দিলো না।
তারপর হঠাৎ পকেট থেকে একটা চেক বই বের করে সাত হাজার পাউণ্ডের একটা চেক লিখে দিলো। বললো, লরেঞ্জো মারকুইসের লয়েডস ব্যাঙ্কে তোমরা এই চেক ভাঙিয়ে নিতে পারবে। কিংবা সেখানে জমা দিয়ে ঢাকা থেকেও টাকা তুলতে পার তোমরা। আমি এখন আর ব্যবসা দেখাশোনা করি না। বাড়িতে থাকি, ধর্ম কর্ম করি। আমার চার ছেলেই সব দেখাশোনা করে। আমি আর কতদিন, হয়তো আর একটা বছরও কাটবে না। আমার ছেলেরা অবশ্য অত্যন্ত সৎ, কিন্তু বলা তো যায় না, টাকা পয়সার ব্যাপার, যদি তোমাদের ঠকাতে চায়। তাই আমি নিজ হাতেই সব দেনা শোধ করে যাচ্ছি। মরবার সময় অশান্তি নিয়ে মরতে চাই না।