পাশাপাশি দুটো কেবিন পেয়ে গেছে শহীদরা। বড় কেবিনটায় শহীদ আর মহুয়া, আর মাঝারি কেবিনে কামাল। গফুর ডেকে ভালো ব্যবস্থা করে নিয়েছে। ফরিদপুরের মানুষ। যাত্রী হিসেবে নোয়াখালির পরেই ফরিদপুরের নাম। সব সময় এরাই ভালো ব্যবস্থা করতে পারে।
কামাল প্রচুর পরিমাণে বমি করেছে। জাহাজের ডাক্তার একটা মিকচার খেতে দিয়েছে তাকে। এখন সন্ধ্যার দিকে কিছুটা সুস্থ বোধ করছে সে।
মহুয়ার কিছুই হয়নি–ওর নৌকা চড়ে অভ্যাস আছে। আর গফুরের তো কথাই নেই। পদ্মা পারের মানুষ। সমুদ্র দেখে জিজ্ঞেস করবে, এ খালের নাম কি?
সন্ধ্যের পর সবাই কেবিনের সামনে ডেক চেয়ারে গিয়ে বসেছে। কয়টা চেয়ার আর মধ্যেখানে একটা টেবিল। ফুরফুর করে হাওয়া আসছে। জাহাজের খাবার ঘর থেকে অনেক মানুষের কথাবার্তার আওয়াজ তালগোল পাকিয়ে একটা গোলমাল হয়ে এখানে এসে পৌঁছোচ্ছে। তবু ভাগ্য ভালো, তাদের কেবিন জাহাজের একেবারে সামনের দিকে। অনেকটা নিরালা। জাহাজের পেটের কাছের কেবিন হলে চিৎকার আর এঞ্জিনের শব্দ মিলে পাগল করে দিতো। এখানেও যে শব্দ কম, তা নয়। একঘেয়ে জল-কল্লোল। এ তবু সহ্য করা যায়।
অনেকক্ষণ বসে আছে তারা। দুবার কফি খেয়েছে। জাহাজের ক্যাপ্টেন অনুরোধ করেছিলেন dinner-টা সবার সাথে খাবার ঘরে খাওয়ার জন্যে। কিন্তু মহুয়া কিছুতেই রাজি হয়নি। কাঁটা চামচ দিয়ে খেয়ে সুখ আছে। কাজেই তাদের খাবার সন্ধ্যার পর দিয়ে গিয়েছিল—অনেক আগে ওরা খেয়ে নিয়েছে।
তিনদিন আগে ছিলো পূর্ণিমা। চাঁদ আজ অনেক দেরি করে উঠছে। পুবের আকাশটা ফর্সা করে দিয়ে চাঁদ উঠলো। ছোটো ছোটো টুকরো মেঘ রয়েছে আকাশে। ঢেউয়ের মাথাগুলো চিকচিক করছে চাঁদের আলো পড়ে। বড় সুন্দর লাগছে শহীদের। পরিবেশটা বড় মিষ্টি। শহীদ বললো, জানিস কামাল, আমার মনে হয় পাহাড়ী ঠিক এই সময়কার রাগ। পাহাড়ী ঠুমরী শুনলে আমার মনে হয় একটা সুন্দর বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে আছি, সামনে বিরাট সমুদ্র! ঠিক এমনি করে চাঁদ উঠেছে। পাঞ্জাবী পাজামা পরে আছি, ফুরফুর করে মিষ্টি বাতাস আমার কাপড় নিশানের মতো ওড়াচ্ছে। মনটা কেমন জানি হয়ে গেছে। গাম্ভীর্য আবার সেই সাথে একটা আনন্দের পুলক। এমন মহান বিস্তারের সামনে এলে মনটা কিছুতেই ছোটো বা হাল্কা থাকতে পারে না। ঠিক এই সময় প্রিয়াকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে-তাকে আঙুল বাড়িয়ে দেখাতে ইচ্ছে করে পৃথিবী কতো সুন্দর।
ঠিক এমনি সময় গজ পনেরো দূর থেকে একটা মিষ্টি আওয়াজ এলো। সরোদের আওয়াজ! চমকে উঠে শহীদ, কামাল। স্বপ্ন না সত্যি? না ভুল শোনেনি তারা, বেজে উঠলো সরোদ। রাগ পাহাড়ী। উঃ, কি অদ্ভুত মিষ্টি! কুয়াশা, কুয়াশা ছাড়া এ আর কেউ , ফিসফিস করে বলে কামাল।
চুপ করে শোন। শহীদ ঠোঁটের ওপর আঙুল রাখে।
অদ্ভুত বাজাচ্ছে কুয়াশা। চোখের সামনে স্পষ্ট ছবি যেন দেখতে পাচ্ছে শহীদ। এমন আর পাক-ভারতের কারও বাজানো সম্ভব না। এতো দরদ পাবে কোথায় অন্য লোকে? যেমন মিষ্টি তেমনি বোল্ড। যখন মিনতি তখন সুরটা কতো ইনিয়ে বিনিয়ে যায়; আর যখন পৌরুষ, তখন কী ভীষণ টোকা। যেন সব ভেঙে চুরমার করে দেবে। সরোদটা পুরুষের বাজনা। পুরুষের ঠিক মনের কথাটা সরোদে যতখানি প্রকাশ করা যায়। অন্য কোনো যন্ত্রে তা যায় না।
আধঘন্টাখানেক বেজে থেমে গেল বাজনা। সত্যিই। এমন বাজনা আর শুনিনি। মহুয়া অনেকক্ষণ পর কথা বলে।
শুনতে পারো না মহুয়াদি। পৃথিবীতে আর কেউ এতো ভালো জায় না।
কে বাজালো? মহুয়া মাথা নিচু করে বসে রইলো।
শহীদ বললো, কিন্তু কুয়াশা চলেছে কোথায়? আমাদের সাথে আফ্রিকা, না, আর কোথাও? আমি কল্পনাও করতে পারিনি এই জাহাজেই রয়েছে সে।
কিন্তু কুয়াশা কেন আমাদের পিছন পিছন চলেছে? কামাল বলে।
আল্লা মালুম!
আর দুদিন পর স্টীমার লরেঞ্জো মারকুইসে পৌছবে। ডারব্যানে নেমে এই স্টীমার ধরেছে শহীদরা। ডারব্যানে তাদের সাথে সাথে জন কতক নিগ্রো আর জন দশেক সাহেব জাহাজ থেকে নেমে স্টীমারে উঠেছে। এতদিন জাহাজে কিন্তু কোনও নিগ্রোকে দেখেনি শহীদ। খুব লক্ষ্য রেখেছিল শহীদ যাত্রীদের ওপর। তার সন্দেহ সত্য হয়েছে। একজন ফুলপ্যান্ট পরা লোক খোঁড়াতে খোঁড়াতে নামলো জাহাজ থেকে। এই দলটার মধ্যে লম্বা সর্দার, আর সেই সেদিন যে পথে তাকে দেখে বিটকেল হাসি দিয়েছিল, সেই লোকটাকে শহীদ দেখেই চিনতে পারলো। কিন্তু কিছুমাত্র চাঞ্চল্য প্রকাশ না করে যেন চিনতে পারেনি এমনি ভাবে স্টীমারে গিয়ে উঠলো সে। ডারব্যান থেকে আরও বহু নিগ্রো যাত্রী উঠলো স্টীমারে। কিন্তু কুয়াশাকে দেখা গেল না।
শহীদ তাকে চিনতে পারেনি মনে করে গতকাল সর্দারটা তাদের সঙ্গে আলাপ করবার চেষ্টা করেছিল। তার ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কতো কথা বলে গেল সে, কতো মিষ্টি করে হাসি দিলো, কিন্তু মহুয়া কিছুতেই তার সামনে গেল না, কোনো কথাই বললো না।
তার কাছ থেকে জানা গেল যে তারা দক্ষিণ রোডেশিয়ার অধিবাসী। অতো Interlor-এ কেউ যায় না, তাই ওদের দেশ এখনও ভালো করে সভ্যতার ছোঁয়া পায়নি। দুএকজন যারা একটু আধটু বাইরে গেছে তারা অল্পস্বল্প ইংরেজি ও পুর্তুগীজ ভাষা জানে। লিষ্পোপোর ধারেই বোঙ্কারা অঞ্চলে ওদের বাড়ি। শহীদের সেদিকে শিকারে যাওয়ার ইচ্ছে আছে জেনে ভারি খুশি হয়ে নিমন্ত্রণ করলো সে। আদর আপ্যায়নের ক্রটি হবে না বলে ভরসা দিলো। শহীদ মনে মনে ভাবলো, তার নমুনা পেয়েছি দোস্তি।