একটু পরেই মহুয়া এসে ঢুকলো। কামাল ভাই কই?
চলে গেল। দশটার সময় আসবে।
বারে। ভাত খাবে না এখানে? আমাকে চিংড়ীর কাটলেট করতে বলে না খেয়েই চম্পট দিয়েছে? আমি কতো কষ্ট করে তৈরি করলাম।
ওর জন্যে তুলে রাখলেই হবে।
গরম গরম তো আর খেতে পারলো না। যাকগে। তুমি চলো ভাত খাবে।
মহুয়া আর শহীদ খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লো। কাল আবার খুব ভােরে উঠতে হবে। কামালের জন্যে একটা ঘরে বিছানা করে দিয়েছে মহুয়া। টেবিলের ওপর গোটা চারেক কাটলেট ঢাকা দিয়ে রেখেছে। গফুর ওকে ঘর দেখিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়বে।
অনেক রাতে মহুয়ার চিৎকার আর ধাক্কায় শহীদের ঘুম ভেঙে গেল। চমকে উঠে বসলে শহীদ, কি, কি হয়েছে মহুয়া?
মহুয়ার বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। আঙুল দিয়ে কাঁচের জানালার দিকে দেখালো।
বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে। এ কয়দিন আকাশ পরিষ্কার ছিলো। রাতের মধ্যে মেঘ জমে বাইরেটা নিকষ কালো করে দিয়েছে। বিজলী চমকে উঠলো। সাথে সাথে শহীদও চমকে উঠে বালিশের তলায় হাত দিলো । দুইটা কালো মূর্তি জানালার গরাদ ধরে ঘরের মধ্যে এক দৃষ্টে চেয়ে রয়েছে। গুডুম গুড়ুম করে মূর্তিগুলোর মাথার ওপর দিয়ে উপর্যপরি দুইবার গুলি ছুঁড়লো শহীদ। ঝন ঝন্ করে জানালার ওপরের দিকটার কাঁচ ভেঙে গেল। সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে মাটিতে পড়লো মূর্তি দুটো। তিন চার সেকেণ্ড পর হঠাৎ আরেকটা গুলির শব্দ শোনা গেল। তারপরেই আর্তকণ্ঠে একজন মানুষের চিৎকার।
মহুয়া এলিয়ে পড়লো বিছানার উপর। শহীদ ব্যস্ত হয়ে ডাকে, মহুয়া! মহুয়া। অমন করছে কেন? কিছু হয়নি, ভয় পেয়ো না। ও মুহু। মুহু?
এমন সময় দমাদম দরজায় ধাক্কা পড়লো। শহীদ, দরজা খোল।
দরজা খুলতেই ছুটে ভেতরে ঢুকলো কামাল। টর্চ নিয়ে শিগগির বাইরে চল। আমি একটা লোককে জখম করেছি।
তুই-ই তাহলে আমার পরে গুলি ছুঁড়েছিলি?
সাত ব্যাটারীর একটা দীর্ঘ টর্চ নিয়ে ও বেরিয়ে গেল বৃষ্টির মধ্যে!
গেটের কাছে চল। কামাল আগে আগে যায়।
কই? নেই তো কেউ!
এইখানটায় পড়েছিল লোকটা। এই দেখ, রক্তের দাগ।
শহীদ চেয়ে দেখলো, সত্যি সত্যিই এক জায়গায় খানিকটা রক্তের দাগ। চারিধারে টর্চ ঘুরিয়ে দেখা গেল কোথাও কেউ নেই।
এই যে রক্তের দাগ। এই পথ ধরে সোজা চলে গেছে। খুব জখম হয়েছে ব্যাটা, অনেক রক্ত, চল দাগ ধরে এগোলে ব্যাটাদের পাবো। কামাল সামনে এগোয়।
এখন আর যাওয়ার দরকার নেই। হাঙ্গামা না বাড়ানোই ভালো। ভাের রাতে তো আমরা কেটেই পড়বে।
শহীদ আর কামাল ফিরে এলো জানালার ধারে। দুই জোড়া পায়ের দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওপর থেকে লাফিয়ে পড়েছিল বলে এই দাগগুলো মাটির মধ্যে গভীর হয়ে বসেছে।
দুই গুলি ছুঁড়লি কেন? কখন জাগলি ঘুম থেকে? শহীদ জিজ্ঞেস করে।
আমি একটা গুলির আওয়াজ শুনে জেগে গেছিলাম। জানালার ধারে আসতেই বিজলীর আলোয় দেখলাম দুইটা মূর্তি দৌড়ে গেটের বাইরে চলে যাচ্ছে। অমনি গুলি ঘুড়লাম। একজন চিৎকার করে বসে পড়লো দেখে ছুটে তোর ঘরে গেছিলাম।
শহীদ ঘরে এসে দেয়াল ঘড়িতে দেখলো সাড়ে তিনটা বাজে। হঠাৎ মহুয়ার কথা মনে পড়তেই ছুটে নিজের ঘরে ঢুকলো। মহুয়া তখন উঠে বসেছে। কামালও পিছন পিছন এসে ঢুকলো ঘরে। মহুয়া বললো, পেলে ওদের? অনেক স্বাভাবিক গলা।
না। রক্তের দাগ ধরে, গেলেই পেতাম, কিন্তু দরকার নেই, তাই গেলাম না।
উঃ। বডে ভয় পেয়ে গেছিলাম। আমি তো প্রথম ভূত মনে করেছিলাম। এখন কয়টা বাজে কামাল ভাই?
সাড়ে তিন, শহীদ বললো, বড্ডো সাহসের পরিচয় দিয়েছো মহুয়া। Bravo, আফ্রিকা জঙ্গলে যাবারই উপযুক্ত।
লজ্জা পেয়ে মহুয়া বললো, না, এই, ঠিক আশা করতে পারিনি কিনা, তাই অতো ভয় পেয়েছিলাম। আর আমার দোষ কি। লোক দুটোর চোখগুলো যে কি সাংঘাতিক রকম জ্বলছিল, দেখলে তুমিও ভয় পেতে।
হা। গোঁ গোঁ আওয়াজ করে চিৎপটাং হয়ে বিছানায় পড়ে যেতাম।
মিছে কথা বলো না, আমি মােটেও গোঁ গোঁ করিনি।
তা করেনি। কিন্তু তোমাকে নিয়ে আফ্রিকা যাওয়া সম্ভব না। তোমার জিনিসপত্র বের করে রাখো, এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে কামালদের বাড়িতে তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাবো। আপাততঃ আমাদের একটু কফি খাওয়াবে? আর কোনোদিন হয়তো। তোমার হাতে কফি খেতে পাবো না।
মহুয়া নিঃশব্দে উঠে চলে গেল। স্টোভ জ্বালিয়ে জল বসিয়ে দিয়ে জানালা খুলে শহীদ আর কামালের দিকে পিছন ফিরে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো।
শহীদ বললো, কই মহুয়া, তোমার জিনিসপত্র খুলে রাখলে না? শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট দিয়ে আফ্রিকার জঙ্গলে আমরা কি করবো? তাড়াতাড়ি করো, আমরা ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে রওনা হবে।
মহুয়া কোনো কথা বললো না, ওদের দিকে ফিরলেও না। ও রাগ করেছে বুঝতে পেরে শহীদ উঠে গেল ওর কাছে। এই বোকা মেয়ে ঠাট্টা বুঝতে পারো না? ঘোরো তো এদিকে, দেখি ও কি কাঁদছো কেন? ছিঃ, ছিঃ আমি ঠাট্টা করলাম, এদিকে তুমি কেঁদে অস্থির।
মহুয়া হাসবার চেষ্টা করলো। ধরা গলায় বললো, আর ভয় পাবো না। হঠাৎ ওদের দেখে ভয় পেয়ে গেছিলাম।
মনে থাকে যেন। আফ্রিকায় কতো কি বিপদ আসতে পারে। মনে মনে তৈরি না থাকলে ঘাবড়ে গিয়ে বিপদে পড়বে। এখন তাড়াতাড়ি আমাদের দুকাপ কফি খাওয়াও তো লক্ষ্মী।
৪.
ফ্লেমিংগো জাহাজ ছাড়লো চিটাগাং থেকে। মস্তবড় জাহাজ। কলম্বো আর মরিশাস হয়ে সোজা দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার ডারব্যান বন্দরে যাবে।