কিছু মাত্র না। আমি সকালে মার হাতবাক্স খুললাম। বাবার কোনও চিঠিপত্র থেকে কিছু বোঝা যায় কিনা দেখতে। একটা জায়গা একটু মিলেছে। চিঠিতে একখানে বাবা লিখেছেন কয়েকজন নিগ্রো স্টীমারে রোজ সাঁঝে তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বিড় বিড় করে কি মন্ত্র আওড়াত। কাল সাঁঝে আমাকে হাত পা বেধে ওরা আমার সামনেও হাঁটু গেড়ে বসে মন্ত্র আওড়েছিল। মনে হয় এই নিগ্রোগুলো সেই একই দলের লোক, অথবা একই উপজাতি বা শাখার লোক।
সে যাক। এখন কি ঠিক করলি? যাবি লিম্পোপো নদীতে?
তাই জিজ্ঞেস করতেই তো তোকে ডাকলাম। আমার তো পুরোপুরি যাবার ইচ্ছে আছে। কিন্তু তোর মা ভীষণ কান্নাকাটি করবেন তুই যেতে চাইলে।
কিছু না। তুই গিয়ে খালি একবার মাকে বলবি, ব্যাস আর কিছু লাগবে না। তোর সাথে মা আমাকে দোজখেও পাঠাতে রাজি হবে।
এদিকে আবার মহুয়াও কান্নাকাটি করবে। ও কিছুতেই যেতে দিতে চাইবে না।
মহুয়াদিকে সঙ্গে নিয়ে যাবি।
বাঃ! Good idea! আমার মাথায় এ কথা একেবারেই আসেনি! পাটিগণিত করে তোর বুদ্ধি খুলে গেছে। শহীদ খুশি হয়ে উঠলো।
কিন্তু আমি যে কামাল আহমেদ আর তুই যে শহীদ খান, তা প্রমাণ করবি কি করে? আফ্রিকায় গেলাম, তখন যদি কুফুয়া বলে তোমাদের পরিচয় প্রমাণ করো, তখন?
বারে। আমাদের পাসপোর্ট থাকবে না সাথে? পাসপোর্টেই তো ছবি থাকবে।
পাসপোর্ট করে কোথায় যাওয়া হচ্ছে তোমাদের? মহুয়া এসে ঢুকলো ঘরে। ঠোঁটের একটু ওপরে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মিষ্টি মুখটা আরও মিষ্টি লাগছে।
কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে শহীদ বললো, আফ্রিকা।
মহুয়া ভাবলো শহীদ ঠাট্টা করছে। হেসে কামালের দিকে চাইলো। কামালের গম্ভীর মুখ দেখে ওর বুকটা ছাঁৎ করে উঠলো।
আফ্রিকা? আফ্রিকা কেন?
লিম্পাপো নদীতে কুণীর শিকার করতে।
ধ্যাৎ, ঠাট্টা করছো।
না মুহ, ঠাট্টা না। সত্যিই যাচ্ছি।
কিছুতেই তোমাদের যাওয়া হতে পারে না।
যে কোনও অবস্থায় আমাদের যাওয়া চাই-ই, গম্ভীরভাবে বলে শহীদ।
আমার কথা শুনবে না? মহুয়ার চোখ ছল ছল করে।
দেখ, কামাল, মেয়ে মানুষের একমাত্র অস্ত্র তুলে নিয়েছে মহুয়া, আর একটু হলেই প্রয়োগ করবে।
মহুয়া হেসে ফেলে বললো, তাহলে বলো সত্যি সত্যিই আর যাচ্ছে না। বিয়ে করে, একটা মেয়ের ইহকাল পরকাল নষ্ট করে ওসব দেশে যাবার কথা ভাবতে হয় বুঝি?
সত্যি সত্যিই আমরা যাচ্ছি মহুয়াদি। তবে তুমি যদি কান্নাকাটি করো সেই ভয়ে তোমাকেও সাথে নেয়ার প্রস্তাব করেছি শহীদের কাছে। তাহলে রাজি আছে তো যেতে দিতে?
নাই বা গেলে অমন দেশে কামাল ভাই।
অনেক কারণ আছে যে যাবার।
কি কারণ?
শহীদ বললো, তোমাকে পরে সব বলবো মহুয়া। আমরা চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই চিটাগাং থেকে রওনা হবো। গফুরকে বললেই হবে, ওই সমস্ত জিনিসপত্র বেধেছেদে ঠিক করে ফেলবে।
লীনা এসে ঢুকলো। কোথায় যাবে তোমরা দাদামণি?
আফ্রিকা।
সত্যি?
মহয়াদিও?
হাঁ।
আমিও যাবো। আবদার ধরে লীনা।
তুই কি করে যাবি। তোর তো সামনে পরীক্ষা। তুই ততোদিন চাচী-আম্মার কাছে থাকবি, আমরা যতো শিগগির পারি ফিরে আসবো।
৩.
আমাদের জাহাজ কি কলম্বো ঘুরে যাবে? কামাল জিজ্ঞেস করলো।
হাঁ। মধ্যেখানে মাত্র দুইটা হলটেজ। কলম্বো আর মরিশাস। কালকে আমরা চিটাগাং রওনা হচ্ছি। ঢাকায় আজই আমরা শেষ রাত কাটাবো। হয়তো আর কোনও দিন ফিরে আসবো না। চাচী আম্মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছিস তো? তুই রাতে আমাদের এখানে থাকবি, কাল খুব ভােরে প্লেন ধরতে হবে।
আমি এক্ষুণি যাচ্ছি। রাত দশটার দিকে জিনিসপত্র নিয়ে এখানে চলে আসবো।
কামাল চলে গেল। রাত তখন আটটা। গফুর এসে ঢুকলো ঘরে।
লীনাকে চাচী আম্মার ওখানে দিয়ে এসেছিস?
হাঁ। ছোটো আপা খুব কাঁদছিল।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শহীদ বললো, তোর দিদিমণিকে ডেকে দে তো।
গফুর দাঁড়িয়ে ইতস্ততঃ করতে লাগলো।
কিছু বলবি? শহীদ জিজ্ঞেস করে।
দাদামণি, আমিও যাচ্ছি তোমাদের সঙ্গে। তোমাদের একলা বিদেশে যাওয়া হবে না।
তুই গেলে আমাদের কি সুবিধা হবে? আরও বাজে হাঙ্গামা বাধাবি।
শহীদ জানতো গফুর যাবেই যাবে। সে হয়তো তাকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একা যেতে দিতেও পারতো। কিন্তু তার দিদিমণিকে সে ভীষণ ভালবেসে ফেলেছে। তাকে সে কিছুতেই একা বিদেশে যেতে দিবে না। তার ধারণা, তাকে ছাড়া হাজার লোকের সাথে গেলেও শহীদরা একা একা যাচ্ছে। ওকে রেখে গেলে ও যে ভীষণ কষ্ট পাবে দিনরাত ভেবে ভেবে, বুঝতে পেরে শহীদ ওরও টিকেট কেটেছে।
তাহলে আমি দিদিমণির জিনিসপত্র খুলে রাখি। তোমরা যা খুশি করো গে যাও, দিদিমণিকে আমি যেতে দেবো না।
আমার বউ নিয়ে আমি যেখানে খুশি যাবো, তাতে তোর কি? শহীদ হাসে।
গফুর কোনও উত্তর পায় না এই কথার। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো সে। শহীদকে সে কিছুতেই বোঝাতে পারে না কতো ভয়ের জায়গা আফ্রিকা। সে দেশে একলা দিদিমণির যাওয়া হতেই পারে না। বললো, তোমরা তো কুমীর শিকার নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, তখন দিদিমণিকে দেখবে কে?
ওর অবস্থা দেখে শহীদ তাড়াতাড়ি বললো, নারে গাধা। তোরও টিকিট করেছি। তোকে ছাড়া গিয়ে কি বিপদে পড়ি না পড়ি তার ঠিক আছে?
গফুরের ঠিক বিশ্বাস হয় না। যাবার সময় ঠিক দাদামণি একটা ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে। ঠিক হ্যায়। সেও পিছন পিছন যাবে। তখন না নিয়ে পারবে না। তাছাড়া সেদিন তার ফটোক তুলে কয়েকটা কাগজে লাগিয়েছে দাদামণি, তার ওপর আবার সে আঙুলের টিপও দিয়েছে- সেজন্যে আবার অল্প অল্প বিশ্বাসও হয় তার। আর কোনো কথা না বলে চলে গেল গফুর।