এই নিগ্রোগুলি বান্টু শাখাভুক্ত। ইহারা যেমন সাহসী ও বলিষ্ঠ তেমনি হিংস্র। আমার সহিত স্টীমারের একজন খালাসী সামান্য দুর্ব্যবহার করিয়াছিল। আজ দুইদিন যাবৎ তাহাকে পাওয়া যাইতেছে না। আমার যতদূর বিশ্বাস এই নিগ্রোগুলি তাহাকে খুন করিয়া জলে ফেলিয়া দিয়াছে। কারণ আমার সহিত খালাসীর ঝগড়ার সময় তাহাদিগকে অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিতে দেখিয়াছিলাম।
এহেন হিংস্র, বলিষ্ঠ ও সাহসী পথপ্রদর্শক লইয়া আমাদের লিম্পোপোর কুমীর নিধনে বিশেষ সুবিধা হইবে। জার্মান গভর্নমেন্ট ইদানীং ঘোষণা করিয়াছে প্রতিটি কুমীরের জন্য এক পাউও করিয়া পুরস্কার দিবে…
তোমার নিকট হইতে আমি এখন সাড়ে চার হাজার মাইল দূরে কিন্তু বিশ্বাস করে৷ সানী, এক মুহূর্ত তোমাকে ভুলিয়া থাকিতে পারি না। অনেক রাতে যখন একফালি চাঁদ উঠে আকাশে, ভৌতিক চাঁদ-আবছা আলো, আবছা অন্ধকার-তখন জাগিয়া বসিয়া তোমার কথা ভাবি। তুমি যদি কাছে থাকিতে!…ইত্যাদি ইত্যাদি।
চাচাজান আর বাবা কি তাহলে কেবল শিকার করতে যাননি, টাকা পয়সার ব্যাপারও ছিলো? কামাল জিজ্ঞেস করলো।
টাকার কথা একটা আছে অবশ্যই, কিন্তু টাকা তাঁদের কম ছিলো না। আসলে গেছিলেন শিকার করতেই, সেই সাথে যদি কিছু টাকাও আসে তো মন্দ কি?
টাকা দেবে কে?
জার্মানী যখন গত মহাযুদ্ধে টাঙ্গাইনিকা দখল করে তখন ঘোষণা করে লিম্পোপো নদীর কুমীর শেষ করতে হবে। প্রতিটি মৃত কুমীরের জন্যে এক পাউণ্ড পুরস্কার। আমার বাবা আর তোমার বাবা গেছিলেন আসলে শিকার করতে। ওখানে গিয়ে যতদূর সম্ভব তাঁর পুরস্কারের কথা জানতে পারেন।
আচ্ছা, তোমরা ওদের মৃত্যু সংবাদ পেলে কি করে? মহুয়া প্রশ্ন করে।
লরেঞ্জো মারকুইস থেকে অ্যান্ডারসন বলে এক সাহেব, দয়া করে জানিয়েছিল।
শহীদ কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইলো। বেশ জোরে বৃষ্টি নেমেছে। গফুর কফি নিয়ে এলো চার কাপ।
কফিতে এক চুমুক দিয়ে কামাল বললো, একটা গান গাও তো মহয়াদি, শ্রাবণের গান
এই বিকেল বেলা কি ভালো লাগবে?
খুব ভালো লাগবে, গাও তো তুমি। আমি সাথে পিয়ানো বাজাবো।
কামাল উঠে গিয়ে পিয়ানোর সামনে বসলো। একটু কেশে নিয়ে শুরু করলো, মহুয়া।
আমি শ্রাবণ আকাশে ওই, দিয়াছি পাতি
মম জল ছল ছল আঁখি মেঘে মেঘে…
যেমন সুন্দর সুর, তেমনি গলা। কলির শেষে এতো সুন্দর করে মীড় টানে মহুয়া! সাথে কামালের পাকা হাতে পিয়ানো, সমস্ত আবহাওয়া একেবারে গম্ভীর করে দিয়েছিল। আজকের এই বাদলা দিন যেন সম্পূর্ণ সুন্দর হলো গানটা শুনে। সবাই অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। মহুয়া উঠে দাঁড়িয়ে বললো, লীনা, ভুনিখিচুড়ি তৈরি করা শিখবে বলে, চলো আজ খিচুড়ি রাঁধবো।
মহুয়া আর লীনা চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। কামাল কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে বসে রইলো। তারপর শহীদকে বললো, কি কথা বলবি বলে?
হ্যাঁ, কাছে আয়।
কামাল কাছের একটা সোফায় এসে বসলো। শহীদ বললো, শোন, তোকে গোড়া থেকে ব্যাপারটা বলি। এই যে চিঠিটা দেখছিস পকেট থেকে একটা খাম বের করলো। শহীদ, এটা আজ সকালের ডাকে আফ্রিকা থেকে এসেছে। না, না, বাবা বা কাকা কারও লেখা নয়; কুফুয়া নামে একজন আফ্রিকান ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এসেছে।
বাবা আর কাকা গেছিলেন সিম্পোপো নদীতে কুমীর শিকার করতে। জার্মেনী তখন ঘোষণা করেছে প্রতিটি কুমীরের জন্যে এক পাউণ্ড করে পুরস্কার দেবে। বাবা আর কাকা এই ব্যবসায়ী কুফুয়ার সাথে যোগ দিয়ে কয়েকশো লোক জোগাড় করে কেবল মাত্র নদীর এক মাইল ঘেরাও করেই সাড়ে নয় হাজার কুমীর একদিনে মারেন। পরে আরও অনেক কুমীর এদের হাতে মারা পড়ে। ঠিক ঠিক টাকা দেয় জার্মান গভর্নমেন্ট। কিন্তু তাদের কুমীর নির্বংশ করার plan বাতিল করে দেয়। তোর বাবা হঠাৎ একদিন বেকায়দায় কুমীরের পাল্লায় পড়ে বাবা আর কুফুয়ার চোখের সামনে তলিয়ে গেলেন লিষ্পেপোর মধ্যে। বাবা নাকি ভীষণ আঘাত পেয়ে পাগলের মতো হয়ে যান। রাইফেল কাঁধে লিস্পোপের ধারে ধারে দিন নেই রাত নেই পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতেন তিনি। কয়েকদিনের মধ্যে বহু কুমীর মারেন বাবা। তারপর একদিন তিনিও আর ফিরে এলেন না।
আমাদের ঠিকানা কুফুর কাছে ছিলো। সে জানতে আমাদের পরিবারে বড় আর কেউ নাই। তাই আজ সতেরো বছর পর আমরা যথেষ্ট বড় হয়েছি মনে করে চিঠি লিখেছে। আমার আর তোর সাত হাজার পাউণ্ড, অর্থাৎ প্রায় নব্বই হাজার টাকা কুফুয়ার কাছে জমা আছে। আমরা যেন সেখানে গিয়ে সে টাকার একটা ব্যবস্থা করে আসি, তার জন্যে সে আমাদের সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। লিখেছে, বাবারা, আমার প্রচুর টাকা আছে, বন্ধুর ছেলেদের টাকা আত্মসাৎ করে আমি স্বর্গে যেতে পারবো না। তোমাদের টাকা পয়সা তোমাদের বুঝিয়ে দিয়ে আমি শান্তিতে মরতে চাই। তোমরা যতো শিগগির পারো রওনা হয়ে যাও। নইলে এই বুড়ো বয়সে আমাকে আবার যেতে হবে তোমাদের দেশে।
অদ্ভুত ভালো বুড়ো তো! কিন্তু একটা কথা আমার মনে হচ্ছে। কিছু Conspiracy-ও থাকতে পারে। কয়েকদিন ধরে কয়েকজন নিগ্রোকে এই বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখছি কেন বলতো? ঢাকায় নিগ্রো, আফ্রিকা থেকে চিঠি, কেমন সন্দেহ হচ্ছে।
তোরও নজর পড়েছে দেখছি! শহীদ হাসলো। তারপর গত সন্ধ্যার ঘটনা সবিস্তারে বললো কামালকে। সবটুকু মন দিয়ে শুনে কামাল বললো, খুবই Serious বলে মনে হচ্ছে। ব্যাপার কিছু আঁচ করেছিস?