দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি। বাটের দু ধার ধরে দাঁড়িয়ে লোকগুলোর সাথে কি কি সব কথা বললেন। লোকগুলো খুব হাসলো, তিনিও হাসলেন। তারপর চলে গেল ওরা।
আধঘন্টার মধ্যেই আমাদের পূজা শুরু হবে। তোমরা এর মধ্যে চলে যাও নদীর পারে। আরেকটা কথা। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলেছে। এখানকার লোকগুলো মহাপ্রলয় অর্থাৎ কেয়ামতকে ভীষণ ভয় পায়। ওদের বিশ্বাস একদিন একজন বিদেশী এসে ওদের দ্বারা নির্যাতিত হবে। সেই বিদেশীর অভিশাপে শুরু হবে মহাপ্রলয় আর তার ফলে এখানকার সব লোক মারা যাবে। আমি ওদের বলবো, যেন আঁচ করতে পারছি সেই মহাপ্রলয়ের বিদেশী এসেছে। এই-চারজনের মধ্যেই একজন হচ্ছে সেই বিদেশী। এদের বলি দেয়া চলবে না।
কিন্তু এই বললেই কি ওরা শুনবে?
না শোনাই তো ভালো। ঠিকই ওরা শুনবে না। অনেকে আমার কথা বিশ্বাস করবে, অনেকে করবে না। অবিশ্বাসীরাই সংখ্যায় বেশি হবে। তারা আমাকে বলবে আমার কাজ চালিয়ে যেতে। আমি ওদের কথামত মন্ত্র-তন্ত্র পড়ে লোকগুলোকে নদীর ধারে নিয়ে যাবো। ঠিক সেই সময় যদি কথা নেই বার্তা নেই রাইফেলের গুলি ছোঁড়া শুরু হয়, তাহলে কারও মনে তিলমাত্র সন্দেহ থাকবে না যে কেয়ামত শুরু হয়েছে। যে যেদিক পারে পালাবে। তখন আমাদের সরে পড়ার খুব সুবিধা হবে।
খুব ভালো বুদ্ধি হয়েছে। আমরা যেই গুলি করবো অমনি আপনি বন্দীদের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেবেন। আমি এখন যাই।
শহীদ বাইরে বেরিয়ে এলো। এদিককার কাজ হয়ে গেছে। এবার ওদিকটা ঠিক রাখতে হবে। ভুট্টাখেতের দিকে কয়েক পা এগিয়েছে শহীদ, হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন সাপটে ধরলো তাকে। অত্যন্ত কষে ধরেছে সে। ভীষণ বলশালী হাতের পেশী স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চাঁদের আলোতেও। পিছন থেকে চাপা গলায় শব্দ এলো, Now Shahid?
কিন্তু বেচারা শহীদকে চিনতো না। এক মুহুর্তের মধ্যে যুযুৎসুর এক পাঁচে পিছনের লোক সামনে চলে এলো। তারপরেই প্রচণ্ড এক লাথি তলপেটে। একটু কুঁজো হয়েছে অমনি তলপেটে আবার হাঁটু দিয়ে প্রচণ্ড এক গুতো। কোঁক করে পড়ে গেল লোকটা মাটিতে। কাছেই একটা শব্দ হলো। শহীদ চেয়ে দেখলো তার পাশে দাঁড়িয়ে মি. ব্লাইদ আরেকজনের তলপেটে হাঁটুর ভীষণ এক তো লাগলো। সেও নিঃশব্দে ঝুপ করে পাটিতে পড়লো। মি. রাইদ বললো, dead.
শহীদ বললো, আমারটাও dead; কিন্তু ইংরেজি ছেড়ে এখন বাংলা বলো তো, কুয়াশা। চলো আগে এগুলোকে টেনে ভুট্টাখেতের মধ্যে ফেলে দিই।
দুজনে জংলী দুটোকে টেনে ভুট্টাখেতের বেশ ভিতরে এনে রেখে দিলো। শহীদ লক্ষ্য করলে তাকে যে ধরেছিল, সে হচ্ছে সেই লম্বা সর্দার। যাক, আর কোনদিন সর্দারী করতে হবে না তাকে, এতক্ষণে আর এক দুনিয়ায় চলে গেছে সে।
তুমি আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালে কখন? শহীদ জিজ্ঞেস করে।
ওই ব্যাটা তোমার মাথায় মারবার জন্যে মুগুর উঠিয়েছিল, তাই চট করে ধরলাম গিয়ে! কিন্তু তুমি আমাকে চিনলে কি করে?
তুমি এমন হাজারটা তাগড়াই মােচ লাগাও না কেন, ফ্রেঞ্চকাট দাড়িও বেশ সুন্দর করে লাগিয়েছ, কিন্তু এমন সুন্দর চোখ দুটো কোথায় লুকোবে বলো তো বন্ধু?
তাহলে বলো আগেই চিনতে পেরেছে। আমাকে?
লরেঞ্জো মারকুইসে যেদিন প্রথম তোমার লঞ্চে উঠেছি, সেদিনই চিনেছি।
তাই তো, চোখ দুটোর জন্যে কিছু বের করতে হয় তো এবার! আমি তোমাদের সাথেই রয়েছি অথচ তোমরা চিনতে পারছে না, এ ভেবে আমি কতো আনন্দই না পেয়েছি, অথচ…! ছিঃ!
হামাগুড়ি দিয়ে চলেছে ওরা। কিছুদূর এসে কুয়াশা বললো, তুমি যাও, আমি আমার সরোদটা নিয়ে আসি।
কিন্তু তোমাকে যে আমার খুব দরকার, বন্ধু। আমরা আজই বাবাকে নিয়ে যেতে চাই। তারই কথাবার্তা হলো এখন। ওরা যখন কুফুয়ার ছেলেদের খালে ফেলতে যাবে তখনই আমরা গুলি ছোঁড়া শুরু করবো।
বেশ। তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি আমার সরোদটা নিয়ে আসি। কাছেই লুকিয়ে রেখেছি ওটা ভুট্টাখেতের মধ্যে।
ওটা থাক না এখন। আনতে গেলে দেরি হবে। আমাদের তাড়াতাড়ি করতে হবে।
আচ্ছা চলো।
মি. রাইদকে দেখেই কামাল শহীদকে বললো, এই ব্যাটাকে আবার কোথেকে পেলি, শহীদ? হঠাৎ উড়ে এসে হাজির!
আমি কুয়াশা, কামাল। কুয়াশা হেসে বলে।
আঁ! কি বললেন? আপনি কুয়াশা? কুফুয়াদের ওখানে নিগ্রো সেজে ছিলেন, এখন দেখছি দিব্যি সাহেব।
তোমাকে কিন্তু মি. ব্লাইদের মতো লাগছে দাদা, মহুয়া বলে।
শহীদ হেসে ফেললো, ও-ই তো ব্লাইদ। এতদিন ছদ্মবেশে আমাদের লঞ্চ চালিয়েছে।
কামাল আর মহুয়া হেসে উঠলো। গফুর ভীষণ লজ্জা পেলো, এতদিন সাহেবকে বাংলায় যা-তা কথা বলেছে মনে করে।
আর দেরি করো না, চলো, খালের ধার এখনও অনেকখানি দূর। কুয়াশা চলতে শুরু করে।
খালের ধারের বিরাট ঝুপড়ীওয়ালা গাছটার নিচে দাঁড়ালো গিয়ে শহীদরা। গাছটার তলায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। আত্মগোপন করে থাকবার পক্ষে এই জায়গাটাই সবচাইতে ভালো।
সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মন্দিরের সামনের মাঠের সবটুকু। অসংখ্য নারীপুরুষ সমবেত হয়েছে সেই মাঠে। ভীষণ হৈ-চৈ। কয়েকটা ঢাকের আওয়াজে কানে তালা লাগবার উপক্রম।
কামাল বললো, পল্টন ময়দানে ফজলুল হকের বক্তৃতা শুনতেও এতো লোক হয় না।
ওদের একটু তাড়াতাড়ি করতে বলো না, রাত অনেক হয়ে যাচ্ছে, মহুয়া বলে। সবাই একটু হাসে। শহীদ হাতঘড়ির দিকে তাকায়। আড়াইটা।