এখন আবার খাবে?
হাঁ, খেয়ে নিই। হয়তো সারারাত পথ চলতে হবে আমাদের। শহীদ চলে গেল আম আনতে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো দশ-বারোটা ইয়া বড় বড় আম নিয়ে। মহুয়া তখন লক্ষ্মী মেয়েটির মতো রুটিগুলোতে মাখন লাগানো শেষ করেছে। গফুর আর কামালকে জাগিয়ে সবাই মিলে পেট পুরে খেয়ে নিলো।
আমগুলো যেমন বড়, তেমনি মিষ্টি। খেতে খেতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কামাল বললো, লীনা বড় ভালবাসে আম খেতে।
মহুয়া হেসে ফেলে কি যেন ঠাট্টা করতে যাচ্ছিলো, কিন্তু কি ভেবে থেমে গেল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে হাঁটা শুরু করলো শহীদরা। অনেক ভুট্টাখেত করেছে জংলীরা জায়গায় জায়গায়। তবে ফলের বাগানই বেশি। এক জায়গায় অজস্র কলাগাছ লাগিয়েছে ওরা। অনেকগুলো কাঁদি ঝুলে রয়েছে। সে কাঁদিও কাঁদি বটে। একজন মানুষের গলা পর্যন্ত উঁচু হবে এক একটা। শহীদরা এগিয়ে চলেছে পুবে। মন্দিরের কাছাকাছি যাবে তারা।
চাঁদের আলোয় বেশ দেখা যাচ্ছে পথ। মাঝে মাঝে ভুট্টাখেতের মধ্যে দিয়ে চলে তারা, মাঝে মাঝে ঘন বাগানের অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে। কামাল বললো, এখানে বন্য জন্তুর কোনও ভয় নেই, তাই না শহীদ?
নেই। কিন্তু সাপের ভয় সমানই আছে।
বহুদূর চলে এলো তারা। পাঁচ ঘন্টা সমানে চলার পর দূর থেকে অনেকগুলো খড়ের-কুঁড়েঘর দেখা গেল। কয়েকজন লোককেও চলাফেরা করতে দেখা গেল বাড়ির আশপাশ দিয়ে। শহীদরা এবার খুব সাবধানে এগোচ্ছে। ধরা পড়ে গেলেই সর্বনাশ হবে। আর বেরোবার পথ নেই। এতো পরিশ্রম, এতো কষ্টের পরিণাম হবে মৃত্যু।
হ্যাঁ, এই কুঁড়ে ঘরটাতেই কাল রাতে শহীদের বাবা ঢুকেছিলেন। একটা ভুট্টাখেত পার হলেই ঘরটা। বেশ অনেকটা দূরে ঘন অন্ধকার গাছের আড়ালে এসে দাঁড়ালো শহীদরা। দূরে কয়েকজন লোক ব্যস্ত সমস্ত হয়ে এদিক ওদিক যাতায়াত করছে। ওটাই বোধ হয় এখানকার সড়ক। আজ জংলীরা সবাই অত্যন্ত ব্যস্ত। খুব বড় একটা ব্যাপার হবে আজ।
কামালদের প্রস্তুত থাকতে বলে শহীদ খুব সাবধানে ভুট্টাখেতের মধ্যে ঢুকে পড়লো। গফুর সাথে আসতে চাইলে ধমক দিয়ে তাকে থামিয়েছে শহীদ। সবাই দুরু দুরু বক্ষে দাঁড়িয়ে রইলো গাছের তলে।
হামাগুড়ি দিয়ে ভুট্টাখেতটা পার হলো শহীদ। চারদিকে চেয়ে দেখলো, কেউ কোথাও নেই। সামনে হাত দশেক খালি জায়গা, তারপরই ঘরটা। আলোটা কমে এলো। শহীদ চেয়ে দেখলো একটা টুকরো মেঘ চাঁদকে আড়াল করেছে। নিঃশব্দে দুতিন লাফে শহীদ ঘরের পিছনে এসে দাঁড়ালো।
লম্বা কাঠ চেলা করে পাশাপাশি পুঁতে ঘরটা তৈরি করা হয়েছে। ওপরে খড়। বেশ মজবুত ঘরটা, কিন্তু কাঠের মধ্যে মধ্যে ফাঁক আছে। একটা ফাঁকে চোখ লাগিয়ে শহীদ দেখলো ঘরে একটা প্রদীপ জ্বলছে। খাটের ওপর শুয়ে আছেন তার-বাবা। কয়েকজন জংলী ঘরের মধ্যে মাটিতে বসে রয়েছে। তাদের মধ্যে কি যেন কথা হচ্ছে।
শহীদের বাবা কি যেন বললেন ওদেরকে জংলী ভাষায়। সবাই বেরিয়ে গেল বাইরে।
লোকগুলো যখন অনেকদূর চলে গেল তখন শহীদ পা টিপে টিপে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লো। ওকে চোরের মতো ঢুকতে দেখে ওর বাবা লাফিয়ে উঠে বসলেন বিছানায়। জংলী ভাষায় কি যেন জিজ্ঞেস করলেন তিনি। শহীদ পরিষ্কার বাংলায় বললো, বাবা, আমি শহীদ, আপনার ছেলে!
স্তব্ধ হয়ে গেলেন ইসলাম খাঁ। তাঁর চোখ দুটোতে বিস্ময়। তিনি স্বপ্ন দেখছেন না তো? একী সম্ভব? নিশ্চয়ই স্বপ্ন।
আমার ছেলে, শহীদ? ইসলাম খাঁ ফিসফিস করে বললেন, I dont believe. আমি বিশ্বাস করি না। You are a beautiful dream, তুমি একটা মধুর স্বপ্ন!
শহীদের চোখে পানি ভরে উঠলো। দুঃখ আর করুণায় বিচলিত হলো অন্তর। বললো, বাবা… আপনাকে উদ্ধার করতে এসেছি আমি।
ইসলাম খানের উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসে। চোখ-মুখ-শরীর কেঁপে ওঠে একটা প্রবল আবেগে। হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন তিনি। শহীদ কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই একেবারে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। চোখে অবিরল অশ্রুর স্রোত। মৃদু ফিসফিস স্বরে বললেন, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না! After seventeen years! God. আমার মােনাজাত তাহলে খোদা মঞ্জুর করেছেন।
শহীদ বললো, আমি একা না। কামাল আর আরও কয়েকজন এসেছে। ওদিকে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে তারা।
তুমি এখানে এলে কি করে, শহীদ?
সে অনেক কথা, বাবা। এখন তাড়াতাড়ি বলুন কি ভাবে আপনাকে নিয়ে সরে পড়া যায়। আমরা অনেক কষ্ট, অনেক পরিশ্রম করে এই পর্যন্ত এসেছি।
আজ এখানে চারজন লোককে কুমীরের কাছে বলি দেয়া হবে। আমাকেই নিজ হাতে দিতে হবে বলি। তারপর…
নদীর ধারে জংলীরা রাতের বেলা যায় না, তাই না? বাধা দিয়ে কাজের কথা বলে শহীদ।
না, যায় না। আমার সাথে মাত্র ছজন যাবে লোকগুলোকে পানিতে ফেলতে। আমরা…
ঠিক আছে। আমরা নদীর ধারে থাকবো। আপনি আমাদের কাছাকাছি এলেই আমরা গুলি করে দুজনকেই খতম করে দেবো। তারপর একটা কিছু বন্দোবস্ত করা যাবে, পালাবার। আমাদের লঞ্চ এখান থেকে মাইল চার-পাঁচেক দূরে নোঙর করা আছে। জলপথেই বোধহয় সুবিধা হবে যাওয়ার।
ছজনকে শেষ করতে পারো হয়তো, কিন্তু আরগুলো? এখানে প্রায় তিন হাজার লোক আছে। সবাই আসবে আজকের এই উৎসবে। এদের ঠেকাবে কি করে? এরা মরণকে ডরায় না।
এমনি সময় শোনা গেল কয়েকজন লোক কথা বলতে বলতে আসছে ওদের ঘরের দিকে। শহীদ দরজা দিয়ে বেরিয়ে কোথাও লুকোবার জন্যে চলে যাচ্ছিলো। ওর বাবা ওকে টেনে আনলেন। ফিসফিস করে বললেন, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে, কথা বলো না।