হৈ-চৈ যখন বেশ অনেকটা দূরে চলে গেছে, তখন শহীদ ধীরে ধীরে নেমে এলো গাছ থেকে। নিচে কামালরা উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছে। ওরা এতক্ষণ কেবল হৈ-হল্লা শুনছে, কি ঘটছে কিছুই বোঝেনি।
শহীদ যা যা দেখেছে সব বললো ওদেরকে। কামাল বললো, যেমনি কর্ম তেমনি ফল। আমাদের খুন করতে এসে এখন যাও বাবারা, কুমীরের পেটে যাও।
ওদের কি মেরে ফেলবে জংলীরা? মহুয়া জিজ্ঞেস করে।
না মারবে না; মেঠাই-মণ্ডা খাইয়ে ট্যাক্সি করে বাড়ি পৌঁছে দেবে, কামাল বলে।
তোর এই উচ্ছ্বাস রাখ তো, কামাল। আমাদের অনেক পথ চলতে হবে, রওনা হওয়া যাক, শহীদ বললো।
রওনা হলো শহীদরা। সারাদিন হাঁটার পর বিকেলের দিকে পাহাড়ের কাছটায় পৌঁছলো তারা। পথে এক জায়গায় বসে ওঁরা কিছু খেয়ে নিয়েছে। সবাই কিছু কিছু করে ব্রান্ডি ও খেয়েছে, কিন্তু তবু পুরোপুরি ক্লান্তি যায়নি। সবারই পা টন্ টন করছে। মহুয়ার তো সবচাইতে বেশি। কিন্তু মুখে কেউ কিছুই প্রকাশ করে না।
আর কিছুদূর যেতেই শহীদ যা চাইছিল তা পেয়ে গেল। ঝড় দেখেই শহীদ বেশ খুশি হয়ে উঠেছিল। কামালকে বলেছিল, এর ফল ভালোও হতে পারে। কামাল তখন কিছুই বোঝেনি। এখন দেখলো, সারির মধ্যেকার পাশাপাশি তিনটা গাছ সম্পূর্ণ উপড়ে পড়ে আছে। আর তার জায়গায় টাটকা গর্ত। সেখানে অল্প জল জমেছে। গাছগুলো সাইক্লোনে ভেঙেছে। সামনে অনেকটা জায়গা ফাঁকা। ইচ্ছেমত ঝাপটা দিতে পেরেছে বাতাস।
ব্যাস। আর চিন্তা কি? এবার অনায়েসে জংলী এলাকায় ঢােকা যাবে।
কিন্তু ভেতরেও যেন বন দেখা যায়? কামাল বললো।
ওগুলো বন না। জংলীদের নিজ হাতে লাগানো ফলের বাগান। চল তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়ি ভিতরে, নইলে কারও চোখে পড়ে যেতে পারি।
গাছের ওপর দিয়ে খুব সাবধানে পার হয়ে এলো ওরা। আসার সময় ব্যাগ থেকে। একটা রুটি আর কিছু মাখন বের করে শহীদ একটা ভাঙা গাছের ওপর রেখে এলো। কামাল ঠাট্টা করে বললো, কিরে, মন্ত্র পড়ে রেখে এলি নাকি। কোনও জবাব না দিয়ে সোজা পুবদিকে চলা শুরু করলো শহীদ।
সত্যি। জংলী হলে কি, লোকগুলোর রুচি আছে। গাছগুলোর তলা তকতকে পরিষ্কার। কোনো আগাছা জন্মাতে পারেনি সেখানে। নানারকম ফলের গাছ রয়েছে, কিন্তু কোনটা এলোমেলো না। যেখানে নারকেল, সেখানটায় কেবলই নারকেল, যেখানে আম, কলা বা অন্য কোনও ফল, সেখানে কেবল তাই। অনেকদূর পর্যন্ত নির্ভাবনায় চলে এলো শহীদরা। হঠাৎ কাছেই কথাবার্তার আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ালো। চট করে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো তারা। দেখা গেল, চার-পাঁচজন জংলী একটা ঠেলাগাড়ি নিয়ে এই দিকেই আসছে। ভুট্টাখেতের পাশ দিয়ে এতক্ষণ আসছিল বলে শহীদরা দেখতে পায়নি ওদের। জংলীরা খেতের ঠিক পাশের বাগানটায় থামলো। দুতিনজন গাছে উঠে গেল। ওই সারিটার সবই আম গাছ। ডাল ধরে ঝাঁকি দিয়ে ওরা অনেক পাকা আম পাড়লো। মস্ত বড় বড় ফজলি আমের মতো আম। কয়েকটা গাছ থেকেই পাড়লো ওরা। তারপর ঠেলাগাড়ি বোঝাই করে আম নিয়ে চলে গেলI
মহুয়া হঠাৎ জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, একটা আমও দিলো না!
চাইলেই পারতে? কামাল বলে।
আর পা চলে না, দাদামণি। গফুর বসে পড়লো মাটিতে।
এই, এখানে শুয়ে পড়িস না। একটু এদিকে সরে আয়, পরিষ্কার ঘাস আছে এখানে। আমরা সবাই এখন শুয়ে-বসে বিশ্রাম করবো। আমাদের আজ অনেক পথ চলতে হবে। কিন্তু একটু আঁধার না হলে চলা ঠিক হবে না। সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত আমরা এখানে বিশ্রাম করবো।
সবাই ঘাসের ওপর বসে পড়লো। গফুর একটু দূরে গিয়ে বসে পড়লো। বললো, দাদামণি, যাবার সময় আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিও। আমি একটু ঘুমাবো।
তো কাল বাহাদুরী করতে গেছিলি কেন গাধা? শহীদ স্নেহের সুরে বললো।
কামাল টান টান হয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর শহীদও। আরও কিছুক্ষণ পর মহুয়াও শুয়ে পড়লো। সবচাইতে ক্লান্ত হয়েছে মহুয়াই। ওর মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে শহীদ।
মহুয়া, ঘুমিয়ে পড়ো না কিন্তু। এই কামাল, শরীরে মশা-মাছি বসতে দিস না।
কিস লিয়ে? আরাম পেয়ে উর্দু বেরোয় কামালের।
সি-সি মাছির নাম শুনেছিস?
চমকে উঠে বসলো কামাল। চোখ বড় বড় করে বললো, যে মাছি কামড়ালে জীবজন্তু ঘুমাতে ঘুমাতে মরে যায়?
হ্যাঁ।
সেগুলো তো আফ্রিকার মধ্যভাগে থাকে, কঙ্গোর কাছাকাছি।
কিছু কিছু সবখানেই থাকে। বিশেষ যেসব জায়গায় মিষ্টি ফলের গাছ আছে সেখানে বেশি থাকে।
কামাল চুপ করে আবার শুয়ে পড়লো। কিন্তু শহীদ লক্ষ্য করে, বড় বেশি হাত-পা নাড়ছে সে। শরীরের কোথায়ও একটু চুলকালেই ও ভাবে, এই বুঝি সি-সি মাছি কামড়াল। কারণে-অকারণে যেখান-সেখানে চুলকাচ্ছে সে। এদিক সেদিক কেবল মাছি দেখছে কামাল। ওর অবস্থা দেখে হেসে ফেলে শহীদ।
অতো ঘাবড়াবার দরকার নেই, কামাল। আমি সি-সি মাছির প্রােটেকশনের জন্যে অ্যানটিসাইড নিয়ে এসেছি সাথে করে। তবু একটু সাবধানে থাকা ভালো, কি দরকার শুধু শুধু ইনজেকশন নিয়ে।
এই কথায় কামাল আশ্বস্ত হলো অনেকখানি। বললো, আমি তো ঘাবড়াইনি মােটেও। মরতে তো একদিন হবেই।
কামাল অনেকটা নিশ্চিত হয়ে শুয়ে রইলো চিতপাৎ। মহুয়া এদিকে ঘুমিয়ে পড়েছে।
সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। গাছের তলাটা ঘন অন্ধকার হয়ে গেছে। আর একটু পরেই ওরা রওনা হবে। শহীদ মহুয়াকে জাগালো আস্তে করে। কামাল আর গফুর তখন নাক ডাকাচ্ছে পাল্লা দিয়ে। ব্যাগ থেকে দুইটা রুটি বের করলো শহীদ। মহুয়াকে বললো, তুমি এগুলো কেটে মাখন লাগাও তো, আমি দেখি কয়টা আম পেড়ে আনা যায় কিনা।