নামবো কি করো, মহুয়া সভয়ে জিজ্ঞেস করে।
সে দেখা যাবেখন। আপাততঃ বৃষ্টিটা তো থামুক। শহীদ জবাব দেয়।
বৃষ্টি পড়ে চলে ঝমাঝম, একটানা। একফোঁটা দুফোঁটা করে সবার গায়েই জল পড়ছে। মহুয়ার কোঁকড়া চুলের ওপর বিন্দু বিন্দু জল জমেছে। অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে।
এমনি সময় খুব কাছ থেকে বেজে উঠলো সরোদ। সবাই একবার সবার দিকে চাইলো, কেউ কোনো কথা বললো না। কুয়াশা ছায়ার মতো তাদের অনুসরণ করছে। আর তা জানাতেও ওর অনিচ্ছা নেই। কিন্তু সরোদ বাজায় কেন? শহীদ ভালবাসে বলে, নাকি না বাজিয়ে থাকতে পারে না?
এটা কি রাগ শহীদ? আর কখনো শুনিনি তো, কামাল বলে।
গৌড় মল্লার।
রূপটা কি এই রাগের?
শহীদ বললো,
গৌড় সারং যো মালহার দোনো
মিলমিলে খেড়েকার
বোলত হয় বরখাতি রিমঝিম
গাও গৌড় মালহার।
সবাই চুপচাপ শুনছে। আধঘন্টার মতো বাজিয়ে থেমে গেল কুয়াশা। তবলা নেই। কিন্তু ওদের কারও খেদ থাকে না। আলাপেই সম্পূর্ণ রূপটা ফুটিয়েছে কুয়াশা, গতের দরকার নেই। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে না। এই অদ্ভুত মানুষটার উদ্দেশ্যে সবারই মাথা নিচু হয়ে আসে শ্রদ্ধায়। কতবড়, কতো উচু মানুষটা! বড় কষ্ট লাগে শহীদের।
বৃষ্টি ধরে এসেছে। শহীদরা নেমে এলো গাছ থেকে। তখনও কুণ্ডলী পাকাচ্ছে পাইথনটা।
১৩.
অনেকদূর পশ্চিমে চলে গেছে শহীদরা। তারপর আবার উত্তরে। জংলী এলাকার কাছে এসে পড়েছে তারা। সেই সারি বাঁধা গাছগুলোর ধার দিয়ে তারা বাঁ দিকের পথ ধরে এগিয়ে চললো।
হঠাৎ কাছেই একটা রাইফেলের শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ালো শহীদ। পুবদিক থেকে এলো শব্দটা। আবার আওয়াজ। এবার আর একটু কাছে থেকে।
শিগগির বনের মধ্যে সরে আয়। সবাইকে নিয়ে শহীদ রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে, গফুর দেখ তো এই গাছটায় চড়তে পারিস কি না। একটা মোটা গাছ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় শহীদ।
গফুর চড়তে চেষ্টা করলো গাছটায়। কিছুদূর উঠেই ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল পা পিছলে। ভেজা গাছে এভাবে বেয়ে ওঠা সম্ভব না। সবাইকে রাইফেল হাতে প্রস্তুত থাকতে আদেশ দিয়ে গফুরের কাঁধে চড়ে গাছটার একটা নিচু ডাল ধরলো শহীদ। তারপর খুব সাবধানে উঠে গেল গাছে। ধীরে ধীরে গাছের আগায় উঠে গেল শহীদ। সেখান থেকে তাকিয়ে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে সে।
গাছের ওপর থেকে শহীদ দেখলো, ফুলপ্যান্ট আর হাফশার্ট পরা চারজন নিগ্রো রাইফেল বাগিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে পুবদিকে মুখ করে। আর তাদের সামনে বেশ কিছুটা দূরে বিশ-পঁচিশজন নেংটি-পরা জংলী দাঁড়িয়ে আছে। দুজন জংলী মাটিতে পড়ে আছে। একজনের কপাল থেকে তাজা রক্ত পড়ছে। এখান থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে জংলীদের মধ্যে ভীষণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু কেউ সাহস করে এগোচ্ছে না, দুজন সাথীকে চোখের সামনে মারতে দেখে। ফুলপ্যান্ট পরা লোকগুলো একপা একপা করে পিছনে সরছে। বোধ করি জংলীরা এদের আক্রমণ করেছিল, তাই এরা গুলি করে দুজনকে শেষ করে দিয়েছে, এখন পালাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই প্যান্ট পরা লোকগুলো কারা। জংলীরা এদের আক্রমণ করে কেন?
কিন্তু পিছনে ওরা কারা? দশ-বারোজন নেংটি পরা লোক মুগুর হাতে পা টিপে টিপে এগোচ্ছে প্যান্ট পরিহিতদের পিছন দিক দিয়ে। শহীদ একবার ভাবে, লোকগুলোকে সাবধান করে দেবে। কিন্তু তাতে নিজেদের বিপদ হতে পারে। জংলীরা তাদেরও আক্রমণ করবে। এই অবস্থায় চুপচাপ দেখে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
প্যান্ট পরা লোকগুলো অতি সাবধানে পিছনে হটে যাচ্ছে। ওরা টেরও পেলো না কী বিপদ ঘনিয়ে আসছে তাদের অজান্তে। সামনের জংলীরা পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে ওরা পিছনে সরছে। শহীদ ভাবে ব্যাটারা ফিরে চায় না কেন একবার।
সৈনিকের মাথার পিছনে চোখ থাকে না; কিন্তু দেখা যায় যুদ্ধ- ফ্রন্টে চলতে চলতে হয়তো কেউ, কোনও কারণ নেই, হঠাৎ শুয়ে পড়লো মাটিতে। কি যেন সন্দেহ হয়েছে তার; আর অমনি তার মাথার ওপর দিয়ে কয়েক ঝাঁক গুলি চলে গেল সাঁ করে। মানুষ কি করে যেন তার বিপদের কথা আগেই টের পায়; কেউ লক্ষ্য করে, কেউ করে না। ঠিক সেই কারণেই, কিংবা শহীদের ইচ্ছাশক্তির জোরে একজন প্যান্ট পরা নিগ্রো ফিরে তাকালো পিছনে। চমকে উঠে কি যেন বললো সে। কিন্তু আর সময় নেই, পিছনের জংলীরা হাত পাঁচেকের মধ্যে এসে পড়েছে। প্রস্তুত হবার আগেই মুগুর হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লো জংলীরা তাদের ওপর।
আধ মিনিটের মধ্যে ওদের হাত থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে মুগুর পেটা করে মাটিতে শুইয়ে ফেললো ওরা। সামনের লোকগুলোও এগিয়ে এসেছে। চারজনকেই হাত-পা বেঁধে ফেললো ওরা। তারপর তাদের প্রত্যেকের বাঁধা হাত আর পায়ের মধ্যে দিয়ে একটা করে বাঁশ ঢুকিয়ে দিলো। দুজন করে জংলী একেক জনকে কাঁধে তুলে নিলো। তারপর হৈ হল্লা করতে করতে রওনা হলো।
কিন্তু ফুলপ্যান্ট পরা নিগ্রোগুলোর মুখ দেখতে পেয়েই শহীদ চিনতে পারলো। কুফুয়ার চার ছেলে! চমকে ওঠে শহীদ। এরা এখানে কেন এরাই তাহলে তাদের ধাওয়া করে এসেছে! কী সাংঘাতিক! তাদেরকে খুন করে রেখে চেক নিয়ে যাওয়ার মতলবে এতদূরে এসেছে এরা! কাল রাতে কামালের সাপ মারার শব্দ শুনে জংলীরা। এদিকটা খোঁজ করতে এসেছিল। কুফুয়ার চার ছেলেকে পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে চলে গেল।