মাইল দুয়েক উত্তরে গিয়ে বাঁ ধারে একটা পথ পাওয়া গেল। সেই পথে এগোলো শহীদরা। জংলী এলাকার খুব কাছে যেতে চায় না ওরা আপাততঃ।
আরও মাইল দুয়েক গিয়ে ওরা একটা গাছের গুঁড়ির ওপর বিশ্রাম করতে বসলো। বেশ গরম। সিগারেট ধরিয়ে একটা টান দিয়ে কামাল আকাশের দিকে লক্ষ্য করে বললো, দক্ষিণে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি হবে না তো?
শহীদও গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখলো, খুব তাড়াতাড়ি ছড়াচ্ছে মেঘটা। ভয়ানক ঝড় হবে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। তার আগেই একটা ঘন গাছের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। উঠে পড়লো সবাই। একটা ঝাঁকড়া গাছের তলায় এসে দাঁড়ালো ওরা। গফুরকে গাছে উঠিয়ে দিয়ে রশি বাঁধিয়ে ওরা গাছের নিচু একটা ডালে উঠে বসলো।
মহুয়া বললো, বৃষ্টি হবে হোক, কিন্তু গাছে উঠলাম কেন? এতে কি বৃষ্টি কম লাগবে?
আমরা যে কারণে এই গাছটা বেছে নিয়েছি Shelter হিসেবে, ঠিক সেই কারণেই তো কোনো হিংস্র জন্তু এখানে আশ্রয় নিতে পারে। ডালের উপর অনেকটা Safe.
শহীদের কথাই ঠিক। যখন টপ টপ করে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হলো তখন কোথেকে দুটা বানর ছুটে এসে এই গাছে উঠে পড়লো। কিন্তু কয়েক ফোঁটা পড়েই বৃষ্টি থেমে গেল হঠাৎ। বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে। একটু পরে উল্টোদিকে বইতে শুরু করলো বাতাস। গফুর বললো, খুব বড় ঝড় হতে পারে, দাদামণি।
আমারও তাই মনে হচ্ছে। কামাল বললো।
মিনিট পাঁচেক আবার চুপচাপ। তারপর শুরু হলো প্রলয় মাতন। দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে কী যেন গোঁ গোঁ করে ছুটে আসছে।
প্রচণ্ড আওয়াজ। মট মট করে গাছ ভাঙার শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। ক্রমেই এগিয়ে আসছে সাইক্লোন।
ঝড়ের শব্দের সাথে সাথে জন্তু-জানোয়ারের ত্রাহী ত্রাহী চিৎকার। শহীদ বড়ো ভুল করেছে। এই বনটার বিশেষত্ব হচ্ছে গাছগুলো সব ছোটো বড়, অন্য অন্য বনের মতো সব সমান না। দক্ষিণ দিকের কয়েকটা গাছ খুব ছোটো, তারপর শহীদদের গাছটা মস্ত বড়। ফলে ঝড়ের ঝাপটা ছোটো গাছে না লেগে ওদের গাছে সোজা এসে লাগবে। একথা আগে ভাবেনি শহীদ। আগেই লক্ষ্য করেছিল সে, গাছগুলোর দৈর্ঘ্য অসমান। সমান হলে কেবল সামনের কয়েকটা গাছের ক্ষতি হতো, গোটা বন অক্ষত থাকতো। শহীদ ভাবছে নেমে যাবে কিনা। না, এখন আর সময় নেই। ঝড় এসে পড়লো বলে।
মহুয়ার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। শহীদ এক হাতে তাকে ধরে আরেক হাতে একটা ডাল জড়িয়ে ধরলো। এসে পড়লো সাইক্লোন। ভীষণ ঝাপটা। গাছ যেন ভেঙে পড়বে বলে মনে হচ্ছে। ছিটকে পড়ে যাবে না তো তারা? কামাল উপরে চেয়ে দেখলো অজস্র পাতা ভয়ানক বেগে উড়ে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে। দুইটা মস্ত বড় বড় ডাল কোথা থেকে যেন ভেঙে এসে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে পড়লো কাছেই কোথাও। প্রচণ্ড শব্দ। কানে তালা লাগার উপক্রম। কয়েকটা জেব্রা এসে গাছের তলায় দাঁড়িয়েছে। ভয়ে থর থর করে কাঁপছে তারা। তাদের পাশ দিয়ে একটা মস্ত বড় বাঘ উদভ্রান্তের মতো একদিকে ছুট দিলো। এতো উপাদেয় শিকারের প্রতি তার লক্ষ্যই নেই। প্রকৃতির এই দানবিক লীলায় সবাই সমান নিরুপায় হয়ে একটু আশ্রয় খোঁজে।
হঠাৎ মড়মড় করে গাছের একটা অংশ ভেঙে শূন্যে চলে গেল। মনে হলো যেন হৃদয়ের একটা অংশই শূন্য হয়ে গেল। ফাঁকা আকাশ দেখা যাচ্ছে। মহুয়া শহীদের বুকে মুখ গোঁজে।
কিছুদর দিয়ে পোঁ পোঁ করে ভীষণ আর্তনাদ তুলে কয়েকটা হাতি দৌড়ে চলে গেল পুবে।
মিনিট পাঁচেক পর সাইক্লোন কমলো। শোনা যাচ্ছে, ক্রমেই সে ভীষণ শব্দ দূরে সরে যাচ্ছে। এবার বৃষ্টি শুরু হলো। আকাশ দেখে বোঝা গেল, বজ্রসহ প্রচণ্ড বারিপাত হবে। এই গাছে থাকলে নির্ঘাৎ ভিজতে হবে। শহীদরা গাছ থেকে নেমে পড়লো। তাদেরকে দেখতে পেয়ে জেব্রাগুলো একদৌড়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
কাছেই আরেকটা অক্ষত ঝাঁকড়া গাছ পাওয়া গেল। শহীদরা তাতে চড়ে বসতেই চেপে বৃষ্টি এলো।
ঝমাঝম ঝমাঝম বৃষ্টি পড়েই চলেছে, থামবার নাম নেই। ঘন্টাখানেক গাছের ওপর ঠায় বসে রইলো ওরা। কড় কড় ক্কড়াৎ করে বাজ পড়ছে এখানে-সেখানে। বিজলী চমকে উঠছে এই দিনের বেলাতেও।
হঠাৎ মহুয়া মাটির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলো, সাপ।
সবাই চেয়ে দেখলো, একটা মস্ত পাইথন গাছে উঠবার চেষ্টা করছে। ও উচু একটা জায়গা চায়, বৃষ্টির জলে নেয়ে গেছে একেবারে। গাছে উঠে এলে সর্বনাশ হবে। কামাল রাইফেল তুললো। বেশ অনেকক্ষণ সই করে গুলি করলো। পেটের কাছে কোয়ার্টার ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা ছড়ে গেল সাপটার। সাৎ করে সমস্ত শরীর পেঁচিয়ে ফেললো সাপটা। কিন্তু চলে যাওয়ার নামও করলো না। কুন্ডলী পাকিয়ে রাগে ফোঁসফোঁস করলো কিছুক্ষণ, তারপর আবার গাছে উঠে আসার চেষ্টা করতে লাগলো।
এবার একেবারে চাঁদি সই করলো কামাল। ফুটো হয়ে গেল মাথাটা। থপ্ করে মাটিতে পড়ে গেল সাপটা। আশপাশের খানিকটা জায়গা লাল হয়ে গেল রক্তের রঙে।
মহুয়া বললো, দেখো, মরেনি এখনও। কি ভীষণভাবে কুণ্ডলী পাকাচ্ছে।
মরে গেছে। মরবার পরেও অনেকক্ষণ এই রকম কুণ্ডলী পাকায় পাইথন। এর মধ্যেও যদি কোনো মানুষ পড়ে তো চাপ দিয়ে দলা করে দেবে। শহীদ ছুরি দিয়ে একটা ডাল কেটে ফেলে দিলো সাপটার কুণ্ডলীর মধ্যে। মড়মড় করে ভেঙে গেল ডালটা। তবু ছাড়ে না, সমানে চাপ দিয়ে চলেছে।