কুফুয়ার একটা কথা শহীদের খুব মনে আছে। কথায় কথায় কুফুয়া বলেছিল, হ্রদের ধারে সবচাইতে বেশি শিকার পাওয়া যায়। তাই জংলীরা দিনের বেলা নানা রকম ফন্দি ফিকির নিয়ে হ্রদটার আশপাশে শিকারে যায়।
শহীদরা ফিরে চললল লঞ্চে। সেখান থেকে দরকারী সব জিনিসপত্র নিয়ে সম্পূর্ণ এলাকাটা একবার ঘুরে দেখবে। তারপর যাহোক একটা কিছু করা যাবে।
যে পথ দিয়ে এসেছিল সেই পথ ধরেই নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা গেল লঞ্চ নেই নদীতে। সবাই থ খেয়ে গেল। এখন উপায়? তারা ফিরবে কিসে করে? ব্লাইদ কি ভয় পেয়ে চলে গেল ওদের ফেলে রেখে?
হঠাৎ একটা কাগজের উপর চোখ পড়লো শহীদের। একটা গাছের গায়ে পোস্টারের মতো করে সাঁটানো। সবাই কাছে গেল কাগজের ওপর লেখা।
5-30 A.M.
Mr Shahid,
I am seeing a mast proceeding in this direction. Perhaps it is our enemys boat. So I am moving towards west. You will find me within half a mile.
- Blythe.
পশ্চিমে তো যাবো, কিন্তু যাবো কোন পথে? সবই তো ঘন বন। কামাল চিঠিটা ছিড়ে নিয়ে বলে।
এরই মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি চলে নইলে ধরা পড়ে যাবে। ওই দেখো নৌকো বাঁধা রয়েছে ঘাটে।
কামাল চেয়ে দেখলো সত্যি একটা নৌকো অদূরে পাড়ে বাঁধা। ব্যস্ত হয়ে কামাল বললো, ওরা বোধকরি নেমে পড়েছে। আমাদের খুঁজছে হয়তো, চলো তাড়াতাড়ি বনে ঢুকে পড়ি।
ঠিক এমনি সময়ে কয়েকজন লোকের কথাবার্তার আওয়াজ শোনা গেল খুব কাছেই। ওরা এইদিকেই আসছে।
সবাই বনের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। বড় বড় গাছ তো রয়েছেই, হাঁটু পর্যন্ত ছোটো ছোটো অসংখ্য ঝাড়। মধ্যে মধ্যে কাঁটাও আছে। পা ছড়ে যাচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে সাপে কামড়াতে পারে। কিন্তু ওদের কারো ভ্রুক্ষেপ নেই, যতদূর সম্ভব সরে যেতে হবে।
বেশ অনেকদূর এসে কামাল জিজ্ঞেস করলো, এরা কারা রে? সেই জংলীর সর্দার দলবল নিয়ে এলো, না এখানকারই জংলীরা আমাদের খুঁজতে বেরিয়েছে?
কি জানি।
সর্দারটা এতো তাড়াতাড়ি চলে আসলো?
আসবেই তো। ওদের পুরোহিত মশাইকে হাতে পেয়ে ছেড়ে দেবে ভেবেছিস এতে সহজে?
আর একটু হলেই ধরে ফেলেছিল প্রায়!
চল, চল, কথা বলিস না। জোরে পা চালা। মহুয়ার কষ্ট হচ্ছে? কাঁধে-চড়বে আমার?
না আমি হাঁটতে পারবো। কষ্ট হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মহুয়া দেখাতে চায় না।
ঘাটের সাথে একদম লাগিয়ে লঞ্চ বেঁধে রেখেছে মি. ব্লাইদ। পাড়ের ওপর চিন্তিত মুখে পায়চারি করছিলো সে। শহীদদের দেখেই উল্লসিত হয়ে উঠলো সে।
আপনার বোটের শব্দ শোনেনি তো ওরা? প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো শহীদ।
না। আমি বৈঠা বেয়ে উজানে এসেছি।
কি বলছেন! এতবড় লঞ্চ আপনি একা বৈঠা বেয়ে এনেছেন? সাংঘাতিক তো! বৈঠা পেলেন কই?
হালটা খুলে নিয়ে বৈঠা করে নিয়েছিলাম। একটু হেসে বললো মি. ব্লাইদ।
শহীদ আর কামালের মুখ হাঁ হয়ে গেল। একে প্রকান্ড হাল, তার ওপর নিচটা লোহা দিয়ে মােড়া; সেটাকেই আবার বৈঠা বানিয়ে স্রোত ঠেলে এতদূর আসা! সোজা কথা? হালটা কামাল তো তুলতেই পারবে না। সেটা বাওয়া তো কল্পনাও করা যায় না। মি. ক্লাইদের হাতের দৃঢ় পেশীর দিকে কামাল একবার সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকালো। দেখে কিন্তু অতোটা মনে হয় না।
শহীদকে বাংলায় কামাল বললো, ব্যাটা গুল মারছে না তো?
না। দেখ না, হালটা পিছনে ওঠানো ছিলো, এখন ঠিক জায়গা মতো বেঁধে রাখছে।
কামাল ব্লাইদের কাছে গিয়ে বাংলায় বললো, কোন দোকানের চাল খাওয়া হয় মশায়ের? এতো শক্তি পাওয়া গেল কোথায়, আঁ? ব্যাটা ভীম কোথাকার!
What?
বলছিলাম, অদ্ভুত শক্তি আপনার। কামাল ইংরেজিতে বলে।
সাহেব বিগলিত হয়ে গিয়ে বললো, না এই সামান্য একটু আছে।
খাওয়া-দাওয়া করে সবকিছু গুছিয়ে নেয় শহীদ। কয়েকটা ব্যাগে পাউরুটি, মাখন আর বিস্কিটের টিন, কিছু রশি, ছুরি, বুলেট, কয়েকটা হাতবোমা, একটা বায়নোকুলার, সাত ব্যাটারীর টর্চটা, আরও অনেক টুকিটাকি জিনিস ভরলো শহীদ। তারপর একেকজনের কাঁধে কয়েকটা করে ঝুলিয়ে দিলো। কি ভেবে কতকগুলো পেরেকও নিলো শহীদ। একেকজন দু বোতল করে পানি নিলো। টু-টু বোর রাইফেলটা সাথে নিলো মহুয়া এবার।
আবার এই জঙ্গল ভেঙে যেতে হবে আমাদের? কামাল চলতে চলতে জিজ্ঞেস করে?
না। সামনেই ভালো রাস্তা পাবো। তখন তো emergeny ছিলো, তাই ঢুকে পড়েছিলাম জঙ্গলেই। একটু ঘুরে এলে ভালো পথেই আসতে পারতাম। নদী থেকে প্রচুর রাস্তা উত্তরে চলে গেছে। কোনও না কোনও পথ পেয়েই যাবো আমরা।
এসব রাস্তা হয় কি করে? মহুয়া জিজ্ঞেস করে।
বন্য জন্তুরা জল খেতে আসে নদীতে। বিশেষ করে জংলী হাতিরা রাস্তা তৈরি করেI
তাহলে তো এসব রাস্তা খুব বিপজ্জনক।
একটা কথা কি জানো, হাতিই বলো আর খরগোসই বলো মানুষকে সব জন্তুই ডরায়। একজন বা দুইজন লোক হলে, আর খুব ক্ষুধার্ত থাকলে বাঘ, সিংহ বা কুমীর আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু আমরা চারজন। এই তিন জানোয়ারের কোনোটাই আক্রমণ করতে সাহস পাবে না। অতএব ভয় কি? দল বেঁধে যদি আসে, চারজন সমানে গুলি ছুড়বো, কার সাধ্য এগোয়? তাছাড়া হাতবোমা তো রয়েছেই।
মহুয়া সম্পূর্ণ আশ্বস্ত হলো। সে এখন বনের শোভা নিরীক্ষণ করতে করতে চলেছে। পথের পাশে কোনো নাম না জানা সুন্দর ফুল পেলে অমনি তুলে খোঁপায় গোঁজে, কিংবা শহীদ বা কামালের শার্টের বোতামের গর্তে পরিয়ে দেয়। বেরসিক গফুরের কানে পর্যন্ত একটা লাল ফুল গুঁজে দিয়েছে সে। গুনগুন করে গান ধরলো মহুয়া। ভালো রাস্তায় পড়েছে তারা। শহীদ আগে আগে চারদিকে অত্যন্ত সর্তক দৃষ্টি রেখে চললো।