কামাল ভাবে; শহীদকে ঘুম থেকে ওঠাবে? না থাক, ও ঘুমাক। চুপ করে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে কামাল।
কিসের শব্দ হয় যেন কামাল ভাই?
কামাল চেয়ে দেখে গফুরের তন্দ্রা কেটে গেছে। ও বলে, চুপ! বাজনা বাজছে, চুপচাপ শুনে যাও।
আবার চোখ বন্ধ করে কামাল। মনে মনে সংস্কৃত শ্লোক আবৃত্তি করেঃ
আরক্ত বর্ণে ধৃত রক্ত যষ্টি
বরৈ ধৃতা বৈরী কপালমালা
বিবঃ সুবীরে যুকৃত প্রবীৰ্য্যঃ
মালা মতো মালবো কৌষি কোয়ম
বাজনা বেজেই চলেছে। কিন্তু খুব আস্তে বাজাচ্ছে কুয়াশা, জংলীরা যেন শুনতে না পায়। কত বড় প্রতিভা, কতো সুন্দর মন, কামাল ভাবে। কিন্তু তাকে সারাজীবন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে। কোনদিন কোথাও একটা সুখের নীড় বাঁধতে পারবে।
উচ্ছল যাযাবরের জীবন তার। কোথাও এতটুকু ভালবাসা এতটুকু স্নেহ নেই তার জন্যে। কতো একা সে! কামাল মরে যেত ওর অবস্থায় পড়লে।
কামাল চোখ খুললো। বাজনার আলাপ একটু দ্রুত হয়েছে।
ছোটো ছোটো তান চলেছে আলাপের সাথে সাথে। হঠাৎ কামালের চোখে পড়লো, ওটা কি? লম্বা কি একটা যেন ঝুলে রয়েছে ওপরের একটা ডাল থেকে। অল্প অল্প দুলছে সেটা। এটা তো ছিলো না আগে! চোখ রগড়ায় কামাল। না, তেমনি দেখা যাচ্ছে, চোখের ভুল না। সাত ব্যাটারীর টর্চ জ্বাললো কামাল। সেই আলোতে যা দেখলো তাতে তার চক্ষু স্থির হয়ে গেল।
ওপরের একটা ডাল থেকে মস্ত বড় একটা সাপ নেমে এসেছে ঠিক মহুয়ার গলার কাছে। এরই নাম মাম্বা। কালনাগিনীর মতো ভয়ঙ্কর এর বিষ।
টর্চের আলোয় চকচক করছে সাপটার চোখ দুটো। সম্মােহিতের মতো একদৃষ্টে চেয়ে আছে সাপটা। জিভটা কেবল এক একবার লকলক করে বেরিয়ে এসে আবার অদৃশ্য হচ্ছে। ভয়ঙ্কর লাগছে দেখতে। আলোটা এতক্ষণে সহ্য হয়ে গেছে তার। এবার সে রাগে ফোলা শুরু করলো। কামাল হতভম্ব হয়ে চেয়েছিল এতক্ষণ। এবার তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রিভলবার বের করলো। গফুর তখনো ঢুলছে। সাপটা খুব সাবধানে নেমে আসছে। আর একটু নামলেই মহুয়ার গলায় ছোবল দিতে পারবে।
রিভলভার ছুড়লো কামাল। রাত্রির নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে গেল এই প্রচণ্ড শব্দে। মাথাটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল সাপটার। তিনচার সেকেন্ড শূন্যে দুলে ঝুপ করে মাটিতে পড়ে গেল সেটা।
সবাই চমকে জেগে উঠেছে। শহীদ উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, কি, কি হয়েছে কামাল?
সাপ মারলাম।
কই? কোথায় সাপ? তাড়াতাড়ি বাঁধন খুলে ফেলে শহীদ।
কামাল নিচে হাত দিয়ে দেখালো। টর্চ জ্বেলে দেখা গেল মস্ত বড় একটা মাম্বা পড়ে আছে মাটিতে আঁকাবাঁকা হয়ে।
মহুয়া ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলো আচমকা ঘুম ভেঙে যাওয়ায়। কামালের কথা শুনে আর মরা সাপ দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বললো, আমি মনে করেছিলাম জংলীরা আক্রমণ করেছে বুঝি।
দাদামণি, আমাকে ধর। গফুরের আর্ত কণ্ঠস্বরে সবাই সচকিত হয়ে তার দিকে তাকালো। এতক্ষণ তার কথা কারও মনে হয়নি। ডাল থেকে ঝুলে রয়েছে গফুর শূন্যের ওপর। গুলির আওয়াজ শুনে সে চমকে গাছ থেকে পড়ে যায়। কিন্তু কামাল আলগোছে বেঁধে রেখেছিল বলে এখনও সম্পূর্ণ পড়েনি, পায়ের সাথে কোনও মতে রশিটা ধরে উল্টো হয়ে ঝুলছে সে। চেষ্টা করেও আর উঠতে পারছে না, কেবল হাত পা ছুঁড়ছে। তার দুরবস্থা দেখে কামাল হেসে ফেললো। শহীদও না হেসে পারলো না।
তাড়াতাড়ি গফুরের পা ধরে ওপরে টেনে আনলো শহীদ। কামালের এতক্ষণে মনে হয়েছে, গুলির সঙ্গে সঙ্গেই বাজনা বন্ধ হয়ে গেছে। শহীদকে কিছুই বললো না সে। কুয়াশা ভাবছে না তো, তাকেই গুলি করবার চেষ্টা করেছে কামাল?
শহীদ ভাবছে গুলির পরিণামের কথা। জংলীদের মধ্যে কোনও সাড়া পড়লো কিনা দেখবার জন্যে গাছের মগডালে উঠে গেল সে। কিছুক্ষণ পর নেমে এসে রাইফেলটা তুলে নিলো কাঁধে। কামালকে বললো, তুই টর্চটা নিয়ে আয় তো আমার সঙ্গে, বোধহয় একটা ভালুক পাশের একটা গাছে উঠেছে। কিম্বা কোনও জংলী। কি যেন আবছা দেখা যাচ্ছে।
ধ্যাৎ, ভালুক কোনদিন গাছে উঠতে পারে? বানর টানর দেখেছিস।
আর বিদ্যা বাড়িস না তো, চল। বইয়ে পড়িসনি ভালুক গাছে উঠিয়া মৌচাক ভাঙিয়া মধু খায়? চল, টর্চটা নিয়ে চল।
যাস না শহীদ। ওটা ভালুক না, কুয়াশা। ভালুক ভেবে কি শেষে বন্ধুকে মারবি?
তুই কি করে বুঝলি যে ওটা কুয়াশা?
এতক্ষণ সরোদ শুনছিলাম ওর। গুলির শব্দে বন্ধ করে দিয়েছে বাজনা।
শহীদ বসে পড়লো ডালের ওপর। হাত ঘড়িতে দেখলো, সাড়ে চারটা বাজে।
বাকি রাতটুকু জেগেই কাটাই, কি বলিস?
রাজি। সিগারেট দে।
একটা সিগারেট নিজে ধরিয়ে কামালকেও একটা দিলো শহীদ। বললো, খুব ভােরে আমরা বনের অন্য দিকে চলে যাবো। গাছের ওপর থেকে দেখলাম জংলীদের দুটো কুঁড়েঘরে বাতি জ্বলে উঠলো। কয়েকজন লোক বাইরে এসে আমাদের এদিকটায় আঙ্গুল দেখিয়ে কি যেন বলাবলি করলো। তারপর আবার ঘরে ফিরে গিয়ে আলো নিভিয়ে দিলো। এতো রাতে কেউ আর আসবে না। কিন্তু ভােরের দিকে ওরা বোধহয় দল বেঁধে এসে এ দিকটায় খোঁজ করবে।
১২.
বড় সুন্দর ভাবে জংলীরা ওদের আস্তানা সুরক্ষিত করেছে। চারপাশে খুব ঘন করে লাগিয়েছে গাছ। সে সব গাছ বড় হয় মােটা হয়েছে, ফলে একটার সাথে আরেকটা লেগে গেছে। ইউক্যালিপটাস গাছের মতো সাদা এই গাছগুলোর শরীর। কোনো বন্য জন্তুর পক্ষে এ প্রাচীর ভেদ করে ওধারে যাওয়া সম্ভব নয়। ওদের এলাকায় ঢুকতে হলে একটাই মাত্র পথ। সে পথ হচ্ছে খালটা। কিন্তু খালের আশপাশে ওদের এতো ঘন বসতি, যে কারও চোখ এড়িয়ে ঢুকে পড়া অসম্ভব। আজ পর্যন্ত কোনো পর্যটক কিংবা বিদেশী কেউ এদের এলাকায় ঢুকতে পারেনি। অনেক পাদ্রী চেষ্টা করেছে, কিন্তু নিজেরা কুমীরের পেটে গেছে। এরা মানুষ হয়নি।