শহীদ আগে আগে চলেছে, পিছনে আলখাল্লা ধারী। বাড়ির কাছাকাছি এসে শহীদ বললো, এসো বন্ধু, আজ মহুয়ার হাতের তৈরি চা খেয়ে যাও। তোমার এই উপকারের জন্যে কি বলে যে তোমায় ধন্যবাদ জানাবো ভেবেই পাচ্ছি না।
কোনো উত্তর নেই। শহীদ পিছন কিরে দেখলে কেউ নেই। তার অজান্তেই আগন্তুক কখন সরে পড়েছে।
শহীদের বুঝতে বাকি নেই, আলখাল্লাধারী কুয়াশা ছাড়া আর কেউ নয়। আর কারও এতো বড় বুকের বল নেই যে চারজন ষণ্ডামার্কা নিগ্রোর সাথে খালি হাতে একা লড়তে যাবে।
কিন্তু কুয়াশার তো তার ওপর প্রতিশোধ নেয়ার কথা। সে তাকে এমন অযাচিত ভাবে বিপদ থেকে উদ্ধার করবে কেন? সে তার বোনকে বিয়ে করেছে বলে? কিংবা ভালবাসা? শহীদ ঠিক বোঝে না। কুয়াশার প্রতি শ্রদ্ধায় তার মাথা নত হয়ে আসে।
কিন্তু এই নিগ্রোগুলো তাকে বন্দী করেছিল কেন? ওই বাক্সেতে পুরে ওকে কি পাচার করবার মতলবে ছিলো ওরা? কিন্তু কেন? কোথায়?
নানা প্রশ্ন তার মাথায় জট পাকায়। কোনটারই সমাধান পায় না সে।
২.
পরদিন বিকেল বেলা। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। মাঝে মাঝে দুই এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে ঢুকছে শহীদের ড্রইংরুমের খোলা জানালা দিয়ে। বৃষ্টির কণাও কিছু কিছু এসে দামী পুরু কার্পেটের খানিকটা ভিজিয়ে দিয়েছে। বাতাসের ঝাপটার সাথে সাথে খুব সূক্ষ্ণ বৃষ্টির কণা এসে লাগছে চোখে মুখে।
লম্বা সোফাটায় শুটিসুটি মেরে শুয়ে শহীদ সঞ্চয়িতা পড়ছে আর মাঝে মাঝে বাইরে বৃষ্টির দিকে চেয়ে কি যেন ভাবছে। শহীদ দেখছে ভিজছে কার্পেটটা। ভিজুক, উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছে করে না।
বাইরে রহস্যময় বিরাট বট গাছটা যেন তার মনের মধ্যে কতো কী গোপন করে নীরবে চেয়ে রয়েছে তার দিকে। যেন একটা বক। এক পায়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে মাছের অপেক্ষা করছে। না, না, বক না, একটা মস্তবড় হিংস্র জংলী হাতী। কী এক যাদুমন্ত্রে শান্ত হয়ে কেবল চেয়ে রয়েছে, আর ভিজছে।
আরও দূরে দৃষ্টি যায় শহীদের। দূরে একটা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। একটা লম্বা বাঁশের আগায় একটা ঝাড়ু আর টুকরি বাঁধা। বৃষ্টির দিন, তাই কাজ বন্ধ। আরেকটা বাঁশের মাথায় একটা কাক বসে বসে ভিজছে।
কি ভাবছো চুপচাপ? মহুয়া এসে ঢুকেছে কখন ঘরে, আরে বেশ তো তুমি, কার্পেটটা ভিজে যাচ্ছে আর নিশ্চিন্ত শুয়ে আছো। কাঁচের জানালা বন্ধ করে দিলো সে। তারপর কাছে এসে মাথার কাছে একটা সোফায় বসে শহীদের চুলের মধ্যে হাত চালিয়ে দিলো।
কামাল কই?
লীনাকে অঙ্ক বুঝিয়ে দিচ্ছে।
ওরা দুজনেই হাসলো। কামাল চিরকাল অঙ্কে লাড্ডু পেতো। লীনার ম্যাট্রিক পরীক্ষার আর মাত্র একমাস বাকি। তাই কামালকে আবার শহীদের কাছ থেকে অঙ্ক শিখে নিয়ে ওকে শেখাতে হচ্ছে। কামালের সদা চিন্তিত মুখ দেখলে মনে হয় পরীক্ষা যেন ওরই।
মুহু, কী যেন খেতে ইচ্ছে করছো, শহীদ আবদারের সুরে বলে।
গফুরকে বড়া ভাজতে দিয়ে এসেছি। হয়ে গেছে প্রায়।
না, বড়া না, কী যেন আরেকটা জিনিস! হাত বাড়ায় শহীদ।
ধেৎ, কেউ দেখে ফেলবে যে! এই, না, সত্যি…
গফুর একটু কাশি দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকলো। এক থালা ভর্তি বড়া। শহীদ সুবোধ বালকের মতো মিটমিট করে চেয়ে রইলো। টেবিলের ওপর থালাটা রেখে গফুর বললো, কামাল ভাই আর ছোটো আপাকে ডেকে দেবো দিদিমণি?
দাও।
গফুর চলে গেল। একটু পরে কামাল আর লীনা এসে ঢুকলো ঘরে। বড়া দেখেই কামাল পুলকিত হয়ে উঠলো। একটা বড় মুখে পুরে এক কামড় দিয়েই আর্তনাদ করে আবার হাতে নিলো। বড়ো গরম!
শহীদের মাথার কাছে বন্ধ করে রাখা সঞ্চয়িতা তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাতে থাকলো লীনা। বোধকরি একটা কবিতা আবৃত্তি করবার ইচ্ছা আছে, ভালো কবিতা খুঁজছে। হঠাৎ একটা চার ভাঁজ করা কাগজ বই থেকে বের করে শহীদকে জিজ্ঞেস করলো, এটা কী দাদামণি? এটা তো এ বইয়ের মধ্যে ছিলো না?
ওটা বাবার একটা চিঠি। মার কাছে লেখা। আজ সকালে মার হাতবাক্স ঘাঁটতে, ঘাঁটতে পেয়ে গেলাম। কামালের দিকে ফিরে বললো, এই চিঠির দুএকটা জায়গা, পড়ছি। শুনে রাখ, পরে তোর সাথে আমার অনেক কথা আছে।
শহীদ হাত বাড়িয়ে লীনার কাছ থেকে চিঠিটা নিলো। অনেক দিনের পুরনো চিঠি, কাগজটা হলদে হয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় কালি চুপসে গেছে, পড়া যায় না। কিছুক্ষণ চিঠিটার ওপর চোখ বুলিয়ে শহীদ পড়তে শুরু করলোঃ
আমাদের স্টীমার এখন তেলাগোয়া উপসাগরের মধ্য দিয়া লরেঞ্জো মারকুইসের দিকে চলিয়াছে। আগামীকাল আমরা সেখানে পৌছাইব।
কতকগুলি সামুদ্রিক পাখি আজ দুপুর হইতে স্টীমারের চতুষ্পার্শ্বে ঘুরিতেছে। এখন সূর্য অস্ত যাইতেছে। কেবল ইঞ্জিনের ধিকি ধিকি শব্দ ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নাই। এই নিস্তব্ধতা বড় ভালো লাগিতেছে। ডেকের ওপর আমার পাশের চেয়ারে বসিয়া ইকবাল– সেও মুগ্ধ হইয়া বাহিরে চাহিয়া রহিয়াছে। মেঘগুলি সিদুরের মতো লাল হইয়া গিয়াছে। তাহার ছায়া আবার জলে পড়িয়াছে; ফলে চতুর্দিকে কেবল লাল আর লাল।
ডারব্যান হইতে কতকগুলি নিগ্রো আমাদের স্টীমারে উঠিয়াছে। আমার সহিত অত্যন্ত ভাব জমিয়া গিয়াছে। ইহারাও লিম্পোপো নদী দিয়া দক্ষিণ রোডেশিয়ায় যাইবে। ইহাদের ভাষা আমরা একেবারেই বুঝি না, তবু ইহাদের ভাবে ভঙ্গিতে বন্ধুত্ব করিবার ইচ্ছা দেখিয়া আমরা অত্যন্ত খুশি হইয়াছি। বিশেষ করিয়া আমাকে ইহারা অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। রোজ সন্ধ্যায় ইহারা আসিয়া আমার সামনে হাঁটু গাড়িয়া উহাদের নিজেদের ভাষায় কি কি সব উচ্চারণ করে। আমি একবর্ণও বুঝি না, কেবল মাথা নাড়ি।