তরতর করে ডালের পর ডাল ধরে গাছের মগডালে উঠে এলো শহীদ আর গফুর! সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বেশ কিছুটা দূরে মন্দিরটার কাছে একটা অগ্নিকুণ্ড জ্বালা হয়েছে। অগ্নিকুণ্ডের ওপর ফুটবলের গোলপোস্টের মতো করে তিনটা কাঠ। ওপরের কাঠ থেকে ঝুলছে দুইটা মস্ত বড় বড় বাইসন। আগুনে পোড়ানো হচ্ছে তাদের। আর তারই চারপাশে অর্ধ উলঙ্গ জংলীরা নাচছে, চিৎকার করছে। মেয়ে পুরুষ সবাই আছে।
সবারই কোমরের কাছে একটু খানি কাপড় জড়ানো। বাকি দেহ উলঙ্গ। আজ বোধহয় ভালো শিকার পেয়েছে, তাই ওদের এত আনন্দ। একটু পরেই কামাল উঠে এলো শহীদের পাশে।
মহুয়া কই?
জেগে উঠে ভয় পাবে হয়তো, গফুর যা তো নিচে।
গফুর নেমে গেল। অনেকক্ষণ ওরা এমনি ভাবে বসে রইলো গাছের মাথায়। আগুন নিতে এসেছে। এবার ওরা পাশের একটা কূপ থেকে জল তুলে ঢালা শুরু করলো আগুনের মধ্যে। অনেক জল ঢালায় আগুন সম্পূর্ণ নিভে গেছে। কজন লোক বাইসনগুলো খুলে এনে মাটিতে রাখলো।
হঠাৎ সবাই চুপ করে গেল। ঢাকও বন্ধ হয়ে গেল। কয়েকজন জংলীর হাতে ভর দিয়ে সাদা ধবধবে আলখাল্লা পরা একজন লোক কাছেরই একটা কুঁড়েঘর থেকে আসছে মন্দিরের দিকে এগিয়ে। অনেক মশাল জ্বালানো হয়েছিল। সেই আলোতে দেখা গেল লোকটা জংলী না। ওদের কালো কালো মুখের পাশে এই মুখটা অনেক ফর্সা লাগছে। বুক পর্যন্ত লম্বা পাকা দাড়ি। সৌম্য মূর্তি। কামাল বললো, ইসলাম কাকা না?
হু।
সেই কতো ছোটো বেলায় দেখেছি, কিন্তু এতদিন পরেও দেখে ঠিক চিনতে পেরেছি।
শহীদ কোনো উত্তর দেয় না। কি যেন ভাবছে সে।
হয়তো ভাবছে, এই যে মানুষটা জংলীদের পুরোহিতের কাজ করছেন তিনি তার বাবা। কতো যুগ তিনি একটা সভ্য মানুষের মুখ দেখেননি, একজন বাঙালী পাননি যে একটু কথা বলবেন। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কতো শত মানুষকে বলি দিয়েছেন কুমীরের কাছে। সতেরো বছর! উঃ পাগল হয়ে যাওয়ার কথা। কতো বিনিদ্র রাত হয়তো তিনি চোখের জলে ভেসে দেশের কথা, স্ত্রীর কথা, শহীদ, লীনার কথা ভেবেছেন। কতো কষ্ট কেটেছে তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত।
সেই আলখাল্লা পরা লোকটা এসে দাঁড়ালো বাইসনগুলোর পাশে। একটা চকচকে ছুরি বের করে বেশ অনেকটা মাংস কেটে নিলো সেগুলোর শরীর থেকে। কিছুক্ষণ কি মন্ত্র পড়লো নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করে। তারপর পুব দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলো। মাংসের টুকরো দুটো নিয়ে সেই ছসাত জন লোক আলখাল্লাধারীর পিছন পিছন চলতে লাগলো। খালটার ওপর দিয়ে একটা ছোটো সাঁকো গেছে, সেই সাঁকোর ওপর গিয়ে মাংসের টুকরোগুলো জলে ফেলে দিলো লোকগুলো।
এইবার কয়েকজন জংলী ধারালো ছুরি দিয়ে ছাল ছাড়ানো শুরু করলো বাইসন দুটোর। আবার ঢাক আর হৈ-হল্লা শুরু হলো। আলখাল্লা পরা লোকটা আবার লোকগুলোর কাঁধে ভর করে কুঁড়ে ঘরটায় ঢুকে পড়লো। তাকে খুব অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে ।
শহীদ আর কামাল নেমে এলো নিচে। গভীর ভাবে চিন্তা করছে শহীদ। কিভাবে এখন অগ্রসর হওয়া যায়?
১১.
গভীর রাত। ঢাক, হৈ-হল্লা থেমে গেছে অনেকক্ষণ। জংলীরা বোধহয় যে যার ঘরে গিয়ে এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। মহুয়া আঘোরে ঘুমােচ্ছে। গফুর বসে বসে ঝিমাচ্ছে ডালের ওপর। কোন সময়ে ঝুল লেগে পড়ে যাবে মাটিতে, তাই কামাল একটা রশি দিয়ে আলগোছে ওকে গাছের সাথে বেঁধে রেখেছে। শহীদের ডিউটি শেষ করে সে কামালকে জাগিয়ে দিয়ে নিজে শুয়ে পড়েছে কামালের জায়গায়, সেও বেশ অনেকক্ষণ হলো। বোধহয় এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে শহীদ।
সময় আর কাটতে চায় না। চারিটা দিক ভীষণ নিস্তব্ধ। অনেকক্ষণ খেয়াল করলে এই নিস্তব্ধতা একজন মানুষকে পাগল করে দিতে পারে। চিন্তা করলেও মনে হয় যেন প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছে। ভাগ্যিস মাঝে মাঝে দূর থেকে বন্য জন্তুর ডাক শোনা যাচ্ছে। তাতে করে নীরবতাটা একটা অখণ্ড রূপ নিতে পারছে না।
এই নিঝুম নীরবতা প্রাণ দিয়ে অনুভব করতে চেষ্টা করলে একটা অতীন্দ্রিয় সুরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করা যায়। মনে হয় শব্দটা যেন পৃথিবীর ডাক। পৃথিবী নিরুদ্দেশের পান অবিরাম সমান গতিতে চলেছে, তারই একটানা একঘেয়ে শব্দ। এই ডাক চিরকালের। চলেছে, চলছে, চলবে।
বিরাট কিছুর সামনে গেলে যেমন মনটা ছেয়ে যায়, তেমনি এই নিস্তব্ধতা মনকে ছেয়ে ফেলে। চেতনা ছাড়া আর কিছুই বেঁচে থাকে না তখন। মাথাটা নিচু হয়ে আসে এক মহান বিরাটত্বের পায়ের কাছে। মনটা ভক্তিপুত হয়ে যায়। সম্পূর্ণ ভাবে আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছে করে কারও কাছে। কিন্তু কার ওপর ভক্তি, কার আছে, আত্মসমর্পণ? ঠিক বোঝা যায় না।
এমনি সময় চমকে উঠলো কামাল। কুয়াশা! সরোদ বেজে উঠেছে। নিশ্চয়ই কুয়াশা! সে ছাড়া কেউ না। কাছেরই কোনো গাছ থেকে আসছে আওয়াজ। এখানে পর্যন্ত এসেছে কুয়াশা! অদ্ভুত। কোথায় তাদের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার কথা, আর সে কিনা, তাদের সাথে সাথে সুদূর আফ্রিকায় এসেছে, পাছে তাদের কোনও বিপদ হয়।
নিজের ভুলে নিজ হাতে সে তার বাবাকে খুন করেছে, এখন ছোটো বোন মহুয়ার যাতে কোনও কষ্ট না হয় তার চেষ্টা সে করছে। সে জীবন দেবে, তবু বোনটার সুখের ব্যবস্থা করে যাবে।
মালকোষ। ঠিক এই সময়কার রাগ। যখন মনটা শান্তি সমাহিত থাকে ঠিক তখনই মানুষের মন গায় মালকোষ। ধ্যানগম্ভীর মূর্তিতে যোগাসনে বসে গাইতে হয় এই রাগ। এতে প্রেম নেই, তাই মালকোষে কখনও ঠুমরী হয় না। মানুষের মন কেবল প্রেমে সন্তুষ্ট থাকে না, ভক্তি চাই, ধ্যান চাই, জ্ঞান চাই।