হাঁ করে কি দেখছো কামাল? আমিই কুয়াশা।
বিস্ময়ে মহুয়ার মুখ হাঁ হয়ে গেল। অস্ফুট কণ্ঠে বললো, দাদা!
পাঁচ মিনিটের মধ্যে চারজন নিগ্রোকেই কষে বেঁধে ফেললো কামাল। তারপর ওরা সবাই বেরিয়ে এলো সে বাড়ি থেকে। মহুয়ার হাত ধরে চলেছে কুয়াশা।
তুমি কি করে খোঁজ পেলে দাদা?
আমি তোদের কাছাকাছিই ছিলাম বোন।
ওরা বোধহয় এখানকার চোর ডাকাত, তাই না?
ওরা হচ্ছে কুকুয়ার চার ছেলে।
আঁ! কুফুয়ার ছেলেরা ডাকাত?
ডাকাত না। তোরা বিদেশ থেকে হঠাৎ উড়ে এসে নব্বই হাজার টাকা ধসিয়ে নিয়ে চলে যাবি, তা ওরা কিছুতেই সহ্য করবে না। কিন্তু বাবাকে কিছু বলতেও পারে না এদিকে। তাই প্ল্যান করে ঠিক করলো, কুফুয়া চেক লিখে দেয়ার পর তোদের কাছ থেকে ওরা কেড়ে নেবে সে চেক। তারপর তোরা লরেঞ্জো মারকুইসে পৌঁছবার আগেই সেটা ভাঙিয়ে নেবে ব্যাংক থেকে। কুফুয়া একবার চেক দিয়েছে, তার আর কোনো দায়িত্ব নেই। তোরা সে চেক হারিয়েছিস তো তার কি? সে আর তোদের টাকা দেবে নাI
ভালো বুদ্ধি খাটিয়েছিল তো! একদিকে বাবাকেও শান্ত রাখতে পারলো, অন্যদিকে ওদের টাকা ওদের কাছেই রইলো।
আরও অনেক কথা হলো ওদের মধ্যে।
তোমরা কাল ভােরেই রওনা হয়ে যাও কামাল। নইলে আরও নতুন বিপদ আছে তোমাদের কপালে। শহীদ বোধহয় ফিরতে চাইবে না এতো তাড়াতাড়ি, বোধহয় বোঙ্কারায় যাবে। সেখানে হলেও কালই লঞ্চ ছেড়ে দিও।
এতো তাড়া কিসের? আগে দুচারদিন বেড়িয়ে নিই, তারপর…
তোমাদের পিছনে কেবল একদল শত্রু নেই কামাল। ভীষণ শক্তিশালী একটা দল গড়ে উঠেছে তোমাদের বিরুদ্ধে। সে দলে অনেক লোক আছে। আমাকে এ বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করো না, শহীদকে জিজ্ঞেস করলেই উত্তর পাবে। কিন্তু মনে রেখো কালই ভােরে লঞ্চ ছাড়া চাই।
এদিকে বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে ওরা। একটা বাঁক ফিরতেই সবাই থমকে দাঁড়ালো। কুফুয়ার বাড়ির দিকের আকাশটা লাল হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে আগুনের লেলিহান শিখা এখান থেকেও দেখা যাচ্ছে। অনেক মানুষের গোলমাল শোনা গেল। ব্যস্ত হয়ে উঠলো কুয়াশা।
পেণ্ডার দিকে তাকিয়ে কুয়াশা বললো, তুমি এদের নিয়ে ঘুরপথে লঞ্চে গিয়ে ওঠো। আমি দেখি গিয়ে ওদিকে কি ব্যাপার।
কুয়াশা পিছন ফিরলো, অমনি তার জামায় টান পড়লো। কুয়াশা ঘুরে দেখে মহুয়া। মহুয়া মিনতি করে বলে, তুমি আমাদের সঙ্গে চলো দাদা। ওখানে বিপদের মধ্যে তোমার যাওয়া হবে না।
অবাক হয়ে মহুয়ার মুখের দিকে চেয়ে থাকে কুয়াশা। বহু যুগ সে কখনও কারও স্নেহ ভালবাসা পায়নি। জীবন পথে কঠোর সংগ্রাম করতে করতে সে প্রায় ভুলেই গেছে মায়া মমতা এসব কাকে বলে। কতদিনের কাঙ্গাল সে। আজ মহুয়ার কণ্ঠে স্নেহের সুর শুনে সে অবাক হবেই তো। তার কথা ভেবে কেউ উদ্বিগ্ন হয়, একথা সে বিশ্বাস করবে কি করে। কারও কাছে তো সে কোনদিন ভালবাসা পায়নি। কেউ তার জন্যে কখনও একবিন্দু উদ্বিগ্ন হয়নি। সবাই তাকে ঘৃণা করেছে, যে পেরেছে সেই নির্মম আঘাত হেনেছে।
আবার মহুয়া আবদার করে বলে, তুমি যেয়ো না দাদা।
উঃ। কুয়াশা সহ্য করবে কি করে ভালবাসার দাবি? চাপ চাপ কান্না তার বেরিয়ে আসতে চাইছে একসাথে। হৃদয়টা বুঝি গুড়ো হয়ে যাবে। কতদিন সে একটু স্নেহ, একটু ভালবাসা পায়নি। হৃদয়ে কতো জ্বালা, কতো অভিমান তার। এই প্রকান্ড মানুষটা এতো দুর্বল? সবাই যার নাম শুনলে চমকে ওঠে, নিঃশঙ্ক চিত্তে যে একটার পর একটা খুন করতে পারে, তার ভিতরটা এতো নরম, এতই স্পর্শকাতর? টন্ টন্ করে কুয়াশার গাল বেয়ে তপ্ত অশ্রু নেমে আসে। ঘুরে দাঁড়িয়ে ধরা গলায় সে বললো, শহীদের কোনো বিপদ হতে পারে, আমি যাই রে।
দ্রুত দীর্ঘ পদক্ষেপে চলে গেল কুয়াশা যেদিক থেকে আলো দেখা যাচ্ছে সেদিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেণ্ডার পিছন পিছন চলতে শুরু করলো মহুয়া।
৯.
ভােরের দিকে শহীদ, গফুর আর কুফুয়া লঞ্চে ফিরে এলো। সারা রাত্রির ধকলে শরীর অবশ হয়ে গেছে। ক্লান্তি নৈরাশ্য সব একসাথে ওদের যেন কাবু করে দিয়েছে। কিন্তু লঞ্চে উঠেই শহীদ দেখলো মহুয়া, কামাল, পেণ্ডা আর কুফুয়ার স্ত্রী বসে আছে। এক মুহর্তে শহীদের সমস্ত ক্লান্তি চলে গেল। সবকিছু শুনলো সে কামালের কাছ থেকে। মহুয়াও মধ্যে মধ্যে কথা যোগ করতে লাগলো। সব শেষে কামাল বললো, কুয়াশা উপদেশ হচ্ছে, এই মুহূর্তে এখান থেকে রওনা হয়ে যাও।
আমিও তাই ভাবছি। কিন্তু তোদের না পাওয়া পর্যন্ত যেতে পারছিলাম না।
এখন কোথায় যাবি? লরেঞ্জো মারকুইসে?
না। দক্ষিণ রোডেশিয়া যাবো।
ওখানে আবার কেন?
সে অনেক কথা, পরে বলবো। এর মধ্যে এখানে অনেক ব্যাপার ঘটে গেছে, সে গল্পও শুনিস পরে। এখন দেখি লঞ্চ ছাড়বার বন্দোবস্ত করি।
কুফুয়ার সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো শহীদ। কুফুয়া তার স্ত্রী আর মেয়ের সঙ্গে জিনিসপত্র নিয়ে নেমে গেল লঞ্চ থেকে। কুফুয়া অনেক করে মাফ চাইলো শহীদের কাছে।
শহীদ বললো, আপনার কি দোষ মি. কুফুয়া? আপনি কিছুমাত্র লজ্জিত হবেন না। আপনি আমার জন্য যা করেছেন তা আজীবন মনে রাখবো। আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ছাড়া আর কিছুই নেই। বাবার বন্ধুর উপযুক্ত কাজ করেছেন আপনি। ছেলেদের দুষ্কর্মের জন্যে আপনি কেন এতখানি লজ্জিত হচ্ছেন?