অনেকক্ষণ কেটে গেছে। আকাশের মেঘ কেটে গিয়ে আবার চাঁদ উঠেছে। শহীদ দেখলো একজন লোক এগিয়ে আসছে বাড়ির দিকে। কুফুয়া রাইফেল তুললো। শহীদ তাড়াতাড়ি তাকে থামিয়ে দিলো হাতের ইশারায়। লোকটা এগিয়ে এসে দেখলো বাড়ি আর নেই, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে লোকটা মাটিতে বসে পড়লো। শহীদ এবার চিনতে পেরেছে। ডাক দিলো, কে ওখানে, গফুর না?
হাঁ দাদামণি। তুমি কোথায়? অকুল সাগরে কুল দেখতে পেয়েছে গফুর।
শহীদ বেরিয়ে এলো গাছের আড়াল থেকে। জিজ্ঞেস করলো, কামাল, মহুয়া কই?
গফুর গড়গড় করে বলে গেল সব ঘটনা। শহীদ আবার ইংরেজিতে কুফুয়াকে বললো।
জিজ্ঞেস করো তো পথ চিনতে পারবে কিনা ও, কুফুয়া বলে।
গফুর বললো, পারবো যদি ওই বিলটা পর্যন্ত কেউ আমাকে নিয়ে যায়।
গফুরকে নিয়ে অনেক ঘুরাঘুরি করে শহীদ আর কুফুয়া একটা জায়গায় এলো। সেখানে মাটিতে কি যেন একটা সাদা মতো পড়ে আছে। সেটা তুলে নিয়ে দেখলো, মহুয়ার রুমাল। গফুর এবার চিনতে পেরেছে। বললো, এই পথে সোজা গিয়ে একটা ডাকবাংলোর মতো বাড়ি, বাইরে দিয়ে সাদা রং করা।
কুফুয়াকে এই কথা বলতেই ঠোঁট কামড়ে ধরলো কুফুয়া। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো, ওই বাড়িটা, আমাদের বাড়ি। সামনের সমস্ত বন আমি কিনে নিয়েছি। সেখানে পাহারা দেবার জন্যে একটা বাড়ি তুলেছিলাম অনেক আগে, ইদানীং সেটা মেরামত করেছি। ওখানেই আমাদের উঠে যাওয়ার কথা। এদিকে আর কোনো বাড়িতে। তো white-wash করা নেই।
কুফুয়াই আগে আগে চললো পথ দেখিয়ে। অনেকদূর। পথ আর ফুরোয়ই না। সবাই ক্লান্ত। ধীরে ধীরে চলেছে তারা।
যখন দূর থেকে বাড়িটা দেখা গেল, গফুর চিনতে পেরে বললো, এই বাড়িই । দাদামণি।
সবাই বাড়িটার দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। একটু ঠেলা দিতেই খুলে গেল দরজা। বাড়ির ভিতরকার সব ঘরগুলোর দরজায় তালা দেয়া। কেবল একটা দরজা দুপাট খোলা। রাইফেল বাগিয়ে ধরে সবাই একসাথে ঢুকলো সে ঘরে।
দেখা গেল চারজন জোয়ান নিগ্রো হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে মেঝেতে। আর কেউ কোথাও নাই।
কুফুয়া আশ্চর্য হয়ে বললো, My sons! (আমার ছেলে!)
৮.
কামাল মহুয়া আর পেণ্ডাকে কাঁধে করে লোকগুলো একটা ঘরে ঢুকলো। আলো জ্বেলে দিলো একজন। সেই আলোতে কামাল চেয়ে দেখলো পেণ্ডার চোখ বাঁধা। মহুয়ার চোখে আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ। তিনজনেরই মুখের মধ্যে কাপড় গোঁজা। কথা বলবার উপায় নেইI
চারজন লোক বিদায় নিয়ে চলে গেল। একজন তাদের বিদায় দিয়ে দরজা বন্ধ করে এলো। এইবার তারা কামাল আর মহুয়ার মুখে গোঁজা কাপড় খুলে ফেললো। স্পষ্ট ইংরেজিতে একজন জিজ্ঞেস করলো, Where is the cheque kufua gave you this moming? কুফুয়ার চেকটা বের করে দিকি।
পেণ্ডা একটু চমকে উঠলো। কামালও যেন একটু হকচকিয়ে গেল। তারপর ইংরেজিতে বললো, সেটা আমার কাছে নেই।
তবে কার কাছে আছে? এই ভদ্রমহিলার কাছে নিশ্চয়ই!
কামাল জানতো চেকটা মহয়ার কাছে ছিলো, আর সেটা ওর ভ্যানেটি ব্যাগের মধ্যেই ছিলো। সে তাড়াতাড়ি বললো, সে চেক আমাদের কারো কাছে নেই, আমার বন্ধু শহীদ সেটা নিজের কাছেই রেখেছে।
মিথ্যে কথা! গর্জে উঠলো লোকটা। ভালোয় ভালোয় চেকটা বের করে দাও। আমি কথা দিচ্ছি তারপর তোমাদের ছেড়ে দেবো। চাই কি বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবো। আমি জানি সেটা তোমাদের দুজনের একজনের কাছেই আছে, শহীদের কাছে নেই।
তুমি সেকথা গায়ের জোরে বললেই হবে? আমি বলছি, নেই আমাদের কাছে।
তাহলে বাধ্য হবো তোমাদের search করতে।
সার্চ করলেও কিছু পাবে না।
Well lets try. বেশ দেখা যাক।
একজন লোককে ইশারা করতেই সে মহুয়ার ভ্যানিটি ব্যাগ তুলে নিলো। তন্ন তন্ন করে খুঁজলো, কিন্তু কোনো চেক নেই ওর মধ্যে। তারপর লোকটা কামালের দিকে এগিয়ে এলো। সমস্ত শরীর তন্ন তন্ন করে খুজলে, কিন্তু চেক পাওয়া গেল না। এবার সে মহুয়ার দিকে এগোলো। কামাল চিৎকার করে ওঠে, খবরদার! মেয়েমানুষের শরীরে হাত দিয়ো না বলছি।
Then hand the cheque over. তাহলে চেক দিয়ে ফেলো।
আমাদের কাছে নেই তো দেবো কি করে?
সেই লোককে আবার ইশারা করলো লোকটা। সে এগিয়ে গেল মহুয়ার দিকে। ইশ, এখন যদি কামালের হাত পায়ের বাঁধন না থাকতো! টুটি টিপে ধরে খুন করতো সে ওই ব্যাটাকে। লোকটা মহুয়ার গায়ে হাত দিতে যাচ্ছে। কামাল অন্য দিকে মুখ ফিরায়।
ঠিক এমনি সময় দরজার কাছ থেকে একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
Hands up, you rascals! Dont move a single step. (মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়াও-একপা নড়বে না কেউ।)
চমকে ফিরে দাঁড়ালো সবাই। একটা প্ৰকাণ্ড নিগ্রো দাঁড়িয়ে রয়েছে সামনের দরজা জুড়ে। হাতে উদ্যত রিভলবার।
সবাই মাথার উপর হাত তুললো। সেই ভীষণ দর্শন নিগ্রো এবার আদেশ দিলো ওদের একজনকে, Untie that gentleman. (ঐ ভদ্রলোকের বাঁধন খুলে দাও)
একান্ত অনুগত ভৃত্যের মতো লোকটা গিয়ে কামালের বাঁধন খুলে দিলো। এইবার নিগ্রোটা কামালকে উদ্দেশ্য করে পরিষ্কার বাংলায় বললো, তুমি এবার মহুয়া আর ওই মেয়েটার বাঁধন খুলে ফেলে। তারপর সব রশি একত্র করে এই ব্যাটাগুলোকে আচ্ছা করে কষে বাঁধে।
তাজ্জব বনে গেল কামাল। এই কাফ্রী মুল্লুকে অপরিচিত নিগ্রোর মুখে বাংলা কথা! কুয়াশা নয় তো। কিন্তু সে তো জাহাজ থেকে নামেনি!