কুফুয়া বাড়ির ভিতরে গিয়ে কি কি যেন বললো ওর স্ত্রীকে। কিছুক্ষণ খুটখাট শব্দ হলো, তারপর দুজন চাকর আর স্ত্রীকে নিয়ে কুফুয়া বেরিয়ে এলো। শহীদ বললো, কামালরা ফিরে এসে যদি ওদের হাতে পড়ে?
পড়বে না। আমরা জিনিসপত্র লঞ্চে রেখে আবার ফিরে আসবো। গাছের আড়ালে থেকে পাহারা দেবো। ওরা এলেই দূর থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবো। যাক, এখন তাড়াতাড়ি চলো লঞ্চে যাওয়া যাক। এরমধ্যে এসে পড়লে ওরা অপেক্ষা করবে।
লণ্ঠন হাতে নিয়ে তারা লঞ্চে গিয়ে উঠলো। দুইটা বড় বড় বাক্স নামিয়ে রাখলো কুফুয়ার চাকরেরা।
আর কিছু দামী জিনিস নেই বাড়িতে?
না। আমরা দুই-একদিনের মধ্যেই আমাদের নতুন বাসায় উঠে যাচ্ছিলাম। সব জিনিসপত্র সেখানে পাঠানো হয়ে গেছে। But wheres your driver. shahid? (কিন্তু তোমার ড্রাইভারটা গেল কোথায়?)
তাই তো! মি. ব্লাইদ গেল কোথায়? নেই তো লঞ্চে।
শহীদ সবখানে খুঁজলো লঞ্চের কোথাও নেই মি. ব্লাইদ। কুমীরে খেলো না তো, শহীদ ভাবে। কুফুয়া বললো, চিন্তার কিছু নেই। আমরা তো বলেই গেছিলাম, তিন-চারদিনের আগে লঞ্চ ছাড়া হবে না। মি. ব্লাইদ বোধহয় এখন তাড়িখানায়। যুবক মানুষ, বুঝলে না? হঠাৎ সুর বদলে কুফুয়া বললো। কিন্তু আমাদের এখন ফিরতে হবে। Be quick.
কুফুয়ার স্ত্রীকে লঞ্চে রেখে ওরা চারজন চলে এলো বাড়ির কাছে। সকলের কাঁধে রাইফেল। পকেটে একটা পয়েন্ট থ্রি টু ক্যালিবারের রিভলবারও নিয়েছে শহীদ। বাড়ি থেকে বেশ দূরে এক একটা গাছের আড়ালে দাঁড়ালো ওরা। কামালদের দেখলেই তাদের নিয়ে লঞ্চে চলে যাবে। আর যদি তার আগেই নিগ্রোগুলো এসে পড়ে, তাহলে তাদের নিয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে হবে, যতক্ষণ না ওরা ফিরে যায়। কুফুয়ার বাড়ির দুই পাশে অনেক ছোটো বড় গাছ জঙ্গলের মতো হয়ে আছে, ধরা পড়বার ভয় খুব কম।
বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো ওরা। রাত দশটা কি এগারোটা বাজে। চারদিক নিঝুম হয়ে গেছে। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। জনপ্রাণী সবাই ঘুমে অচেতন। একটা ভীষণ কিছু ঘটবার আগে যেমন গুমােট হয়ে যায়, চারদিকটা তেমনি চুপ, তেমনি গুমােট।
হঠাৎ বহু দূরে অনেকগুলো পদধ্বনি শোনা গেল। যেন বীর দর্পে অনেক সৈনিক পা ঠুকে ঠুকে এগিয়ে আসছে। ক্রমেই শব্দটা স্পষ্ট হতে লাগলো। কুফুয়া এসে শহীদের পাশে দাঁড়ালো। ফিসফিস করে বললো, ওই শোনো। ওরা এগিয়ে আসছে। ভয় পাওনি তো?
না, ভয় পাইনি।
আরও এগিয়ে এলো তারা। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে আলো দেখা যাচ্ছে। ক্রমে আলো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। শহীদ দেখলো, জ্বলন্ত মশাল হাতে প্রায় শদুয়েক লোক এগিয়ে আসছে কুফুর বাড়ির দিকে। মশালের লাল আলো, আর নিগ্রোগুলোর কালো বিকট মুখ একটা ভয়াল পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। সকলের হাতে একটা করে বর্শা। আলো পড়ে চিকচিক করছে ফলাগুলো।
আরও ঘন জায়গায় সরে গেল শহীদ আর কুফুয়া। সামনে থাকলে এতো আলোতে ধরা পড়ে যেতে পারে।
লোকগুলো যখন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো, তখন সামনের লোকটাকে দেখে চমকে উঠলো শহীদ। এ তো সেই লম্বা সর্দার! আজই এখানে পৌঁছে এদের দলে যোগ দিয়েছে। সব লোকের মধ্যে কেবল তার হাতেই একটা রাইফেল। আজ তারা শহীদকে ধরে নিয়ে যাবেই।
ওরা ভাবছিলো, কাছাকাছি আসতেই গুলি ছুঁড়বে কুফুয়ার লোক। কিন্তু কোনও বাধা না পেয়ে বরাবর এসে থমকে দাঁড়ালো তারা বাড়ির সামনে। কিন্তু সে কিছুক্ষণের জন্যে। তারপরই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো কয়েকজন বাড়ির মধ্যে। কিছুক্ষণ পরেই আবার তারা বেরিয়ে এলো। সবাইকে ডেকে লম্বা লোকটা কি যেন বললো চিৎকার করে। হৈ-চৈ পড়ে গেল ওদের মধ্যে। আশেপাশে অন্ধকার জায়গাগুলো ওরা খোঁজা শুরু করলো। এই দেখে শহীদ আর কুফুয়া এক পা এক পা করে পিছনে হেঁটে অনেক দূর পিছিয়ে গেল।
হঠাৎ শহীদ লক্ষ্য করলো আকাশটা লাল হয়ে গেছে। কুফুয়া বললো আমার বাড়ি পুড়িয়ে দিলো ওরা। জিনিসপত্র ভাঙাচোরার শব্দ শহীদরা পেয়েছে, কিন্তু এতোটা আন্দাজ করেনি।
অনেকক্ষণ ওরা বাড়িটার চারপাশে হৈ-চৈ করলো, তারপর ফিরে চলে গেল।
ওরা বোধহয় লঞ্চে খোঁজ করতে চললো। ওখানে আপনার স্ত্রী একা রয়েছেন।
যাবে না ওরা লঞ্চে। রাতেরবেলা নদীর পঞ্চাশ হাতের মধ্যে ওরা যায় না। ধর্মের নাকি নিষেধ আছে। সেজন্যেই আমি জিনিসপত্র লঞ্চে উঠিয়েছি। কাল দিনের বেলা নতুন বাড়িতে চলে যাবো।
আমার জন্যেই আপনার এতো কষ্ট হচ্ছে। শহীদ বিনয় করে বলে।
Dont say this young man. I feel Insulted, আমার অতিথির জন্যে কি আর কেউ কষ্ট বরণ করবে? Will I bear it? I do all these surely for my own sake, not yours, একথা বলে আমাকে অপমান করো না।
কাঠের বাড়ি। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে যেমন বেশি সময় লাগেনি, তেমনি আগুন নিভে আসতেও আধঘন্টার বেশি লাগলো না। সমস্ত ভস্ম হয়ে গেছে। স্তুপের মধ্যে অবশ্য আগুন এখনও গনগন করছে। কিন্তু তাও নিভে গেল প্রচণ্ড বৃষ্টিতে।
শহীদ, কুফুয়া আর কুফুয়ার চাকর দুজন তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। কামালরা এখনও ফিরছে না কেন? রাত আড়াইটা বেজে গেছে। নিশ্চয়ই কোনও বিপদে পড়েছে ওরা। কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে গেলে অন্ততঃ একটা খবর তো পাঠাতো পেণ্ডা। কিন্তু এখন কোথায় খুজবে ওরা? ভাের পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। কুফুয়ার মুখ অত্যন্ত গম্ভীর।