কিছুদূর গিয়ে গফুর আর কামালদের দেখতে পেলো না। একটা ঘন অন্ধকার জায়গায় তারা অদৃশ্য হয়েছে। বিড়িটা শেষ হয়ে গেছে, একটা সুখ টান দিয়ে গফুর ফেলে দিলো বিড়ি। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে চললো সে। অন্ধকার জায়গাটায় এসে পড়েছে, গফুর, এমন সময় কাছেই একটা ঝটপটির আওয়াজ শোনা গেল। কয়েকজন মানুষ মৃদুস্বরে কথা বলছে। গফুরের কেমন যেন সন্দেহ হলো। কামাল ভাইদের দেখা যাচ্ছে না কেন? সে কি জোরে ডাকবে নাম ধরে? না, তাতে বিপদ হতে পারে।
একটা গাছের আড়ালে দাঁড়ালো সে। কাছেই একজন লোক টর্চ জ্বালালো। সেই আলোতে গফুর দেখলো, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে কামাল, পেণ্ডা আর তার দিদিমণি। সবারই মুখের মধ্যে কাপড় গোঁজা। কেউ চিৎকার করতে পারছে না। আট দশজন লোক তাদেরকে কাঁধের ওপর তুলে নিলো। তারপর পিছনে যতদূর দেখা যায় টর্চ জ্বেলে দেখে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো যে পথে ওরা গিয়েছিল সেই পথেই।
মাথায় রক্ত চড়ে গেল গফুরের। কিছু না পারে, অন্ততঃ একজন লোকের টুটি তো সে ছিড়ে ফেলতে পারবে। তারপর যা হয় হোক। তার দিদিমণিকে আক্রমণ করার মজা সে টের পাইয়ে দেবে। ওদের দিকে জোরে হাঁটা শুরু করলো গফুর। পরক্ষণেই আবার ভাবলো, এতো লোককে আক্রমণ করা মানেই এদের হাতে বন্দী হওয়া। তা সে চায় না। দাদামণিকে সব খবর দিতে হবে, নইলে উদ্ধারের কোনো পথই থাকবে না। এদের পিছনে পিছনে গিয়ে দেখতে হবে এরা যায় কোথায়।
বেশ কিছুটা পিছিয়ে এলো সে। কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখলো লোকগুলোর উপর।
কুফুয়ার বাড়ি বাঁ দিকের রাস্তায়, সে রাস্তায় না গিয়ে এরা ডান দিকের একটা পথ ধরলো। অনেকটা পিছনে গফুরও চললো। মাঝে মাঝে বড় ফাঁকা জায়গা পড়লে সে হামাগুড়ি দিয়ে এগোয় ধরা পড়বার ভয়ে।
ডান দিকের রাস্তা ধরে বরাবর মাইল দুয়েক চলে গেল তারা। এদিকে লোকালয় নেই। গাছ-গাছড়া বেশ ঘন হয়ে এসেছে। পথটা সরু হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। আর কিছুদূর গেলেই ঘন বনের মধ্যে পড়বে তারা।
আকাশে চাঁদ উঠছে এখন। বেশ খানিকটা পরিষ্কার হয়ে এসেছে অন্ধকার। একটা বাঁক ঘুরতেই গফুর ডাকবাংলোর মতো ফুটফুটে একটা বাড়ি দেখতে পেলো। কাঠের বাড়ি, বাইরেটা চুনকাম করা। চাঁদের আলোয় ধব ধব করছে বাড়িটা।
লোকগুলো সে বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। একজন এগিয়ে গিয়ে দরজার তালা খুললো, তারপর সবাই ঢুকে পড়লো বাড়ির মধ্যে।
একটা গাছের আড়ালে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো গফুর। কেউ আর বাইরে আসে না। আরও খানিকক্ষণ পর চারজন লোক বেরিয়ে এলো বাড়িটা থেকে। তারা ফিরে চললো যে পথে এসেছিল সেই পথে। সশব্দে দরজা বন্ধ হয়ে গেল বাড়িটার। অনেকখানি পিছনে থেকে গফুরও চললো ওদের সাথে সাথে। অনেকদূর গিয়ে একটা ছোটো খড়ের ঘরে ঢুকলো ওরা সবাই।
কিন্তু এই বাড়িগুলো এমন কেন? একটা এদিকে আরেকটা ওদিকে এবড়োখেবড়ো করে সাজানো। বিকেলবেলা বেড়াতে যাওয়ার সময় তো বাড়িগুলো এমন দেখেনি সে, পরিপাটি করে সাজানো ছিলো সেসব কুঁড়েঘর। পথ ভুল হলো নাকি? হ্যাঁ, ঠিক ভুল পথে এসেছে সে।
আবার অনেকদূর ফিরে গেল গফুর। রাস্তাগুলো এমন যে চেনা যায় না, একেঁবেকেঁ চলেছে পথ। এক রাস্তা থেকে আবার বহু রাস্তা বেরিয়েছে। ঠিক সমানই চওড়া। সেগুলো আবার ঠিক অন্য সব রাস্তার মতো এঁকেবেঁকে চলেছে। একটা রাস্তা আন্দাজ করে গফুর চলতে শুরু করলো। মাইলখানেক যাওয়ার পর দেখলো সামনে লিপোপো নদী। আবার ফিরে গেল সে।
এমনিভাবে অনেক ঘুরেও ঠিক রাস্তা সে কিছুতেই চিনতে পারছে না। রাগে, দুঃখে, ক্লান্তিতে তার অবস্থা কাহিল। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গেছে। আর চলা যায় না। রাতও এদিকে অনেক হয়েছে। তার বুদ্ধি লোপ পাওয়ার উপক্রম হলো। অনেকক্ষণ রাস্তার উপর বসে রইলো। একটা বিড়ি খেলো। তারপর আবার চলা শুরু করলো সে। এদিকে আকাশে মেঘ করেছে অনেকক্ষণ ধরে। চাঁদ সেই যে মেঘের আড়ালে গেছে আধঘন্টা আগে আর বেরোবার নাম নেই। আবছাভাবে পথ দেখা যাচ্ছে। অনেকদূর এসে সে কতগুলো বাড়ি দেখতে পেলো। কিছুমাত্র উৎসাহিত হলো না সে। এই গোলকধাঁধায় পড়ে তার সমস্ত উৎসাহ নিভে গেছে ঘুরতে ঘুরতে। এদিকে ঝম্ ঝম্ বৃষ্টি নেমে এলো বড় বড় ফোটায়।
আর চিন্তা করবার অবসর নেই। সে ছুটে গেল একটা বাড়ির সামনে। ছোট্ট দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে চিৎকার করতে লাগলো, কে আছো ভাই বাড়িতে ও ও ভাই, কে আছো?
একজন বৃদ্ধ নিগ্রো বেরিয়ে এলো। ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বিরক্ত হয়েছে সে। গফুর তাড়াতাড়ি বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লো। আরও কয়েকজন লোক ঘুম থেকে উঠে এসেছে। গফুরের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে তারা। একজন কি জানি জিজ্ঞেস করলো গফুরকে। কিছু বুঝলো না গফুর। ওরা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে পরীক্ষা করছে তাকে। প্রমাদ গোনে গফুর। আচ্ছা মুশকিলেই পড়া গেল তো। কেউ ওর কথা কিছু বুঝবে না। হঠাৎ ওর মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। ও, বললো, এই হারামজাদারা, তোরা কি আমাকে কুফুয়ার বাড়ি পৌঁছে দিতে পারবি?
এইবার বুঝলো তারা। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে কুফুয়া কুফুয়া করে কি কি সব বলাবলি করতে লাগলো। তারপর একজন জোয়ান নিগ্রো তার হাত ধরে বাড়ির বাইরে নিয়ে এলো। গফুরকে সঙ্গে আসতে ইশারা করে সে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে শুরু করলো। প্রায় পাঁচ-ছ মাইল হাঁটার পর গফুর চিনতে পারলো, বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে তারা। লোকটার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। তারপর একটা বিড়ি বের করে দিলো। লোকটা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে সে নিজে বিড়ি ধরালো। বাংলায় বললো, এইভাবে খেতে হয়। বলে টান দিয়ে দেখালো। লোকটা বুঝতে পেরে বিড়িটা ধরিয়ে নিলো। একবারও কাশলো না দেখে গফুর বুঝলে তামাকে অভ্যাস আছে ব্যাটার। আরও কয়েকটা বিড়ি সে ধরিয়ে দিলো লোকটির হাতে। খুব খুশি হলো নিগ্রোটা। গফুর বাড়ি চিনতে পেরেছে দেখে সে ফিরে চলে গেল। একটা বিটকেল হাসি দিয়ে।