কামালরা আরও দক্ষিণে চলে গেল হাঁটতে হাঁটতে। দূরে মেঘের মতো দেখা যাচ্ছে একটা বিরাট পাহাড়। কিছুদূর গিয়ে একটা বিল পাওয়া গেল। চওড়া খুব বেশি না। কিন্তু অত্যন্ত লম্বা। বহুদূর গিয়ে বাঁ পাশে বেঁকে গেছে। আরও কতদূর গেছে কে জানে। পেণ্ডার কাছ থেকে জানা গেল ওটা একটা হ্রদ।
কামাল বললো, বাড়ির এতো কাছে এতো সুন্দর হ্রদ আছে আগে বলেননি কেন? বোকার মতো আমরা তোলা জলে স্নান করলাম।
বোকার মতো নয়, বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছেন, মি. কামাল। এখানে নামলে আর ফিরতে হতো না। চিরকালের জন্যে রয়ে যেতে হতো। সুন্দর পরিষ্কার ইংরেজিতে বললো পেন্ডা। মিশনারীদের স্কুলে পড়ে খুব ভালো আয়ত্ত করেছে সে ইংরেজি উচ্চারণ।
কি ব্যাপার, এখানেও কুমীর নাকি।
ছিলো না আগে। কুমীরের ভয়ে মানুষ লিম্পোপোতে নামতো না, আগে এখানেই স্নান করতো। কিন্তু কি করে জানি কুমীরেরা এ জায়গার খোঁজ পেয়েছে। হঠাৎ একদিন দেখা গেল এই হ্রদ থেকে একজন মানুষকে মুখে নিয়ে একটা কুমীর লাফ দিয়ে ডাঙায় উঠলো, তারপর প্রচণ্ড বেগে দৌড়ে গিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মানুষজন তাড়া করেছিল। কিন্তু কেউ এগোতে পাড়লো না। লেজের প্রচণ্ড ঝাপটায় বড় বড় মাটির চাকা আর পাথর ছুড়তে ছুড়তে চলে গেল কুমীরটা। তারপর থেকে তিন-চারদিন একই ব্যাপার ঘটলো। প্রতিদিনই কয়েকজন মানুষ মুখে করে নিয়ে যায় কুমীর। রাতে চুপি চুপি এসে ঘাটের কাছে জলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকে, দিনের বেলায় সুযোগ পেলেই একজন লোককে মুখে করে নদীতে চলে যায়। তারপর পাহারাদার বসিয়ে দেয়া হলো, কাউকে আর নামতে দেয়া হতো না। এখন আর কেউ নামে না এখানে। ভুল করে বিদেশী কেউ নামলে সাথে সাথে কুমীরের পেটে যায়।
এখানকার সবাই কি তাহলে তোলা জলে স্নান করে রোজ?
এখানে সবাই এক সপ্তাহ পর পর স্নান করে। কেউ কেউ আরও দেরিতে করে। তোলা জলে স্নান করতে অসুবিধে বিশেষ হয় না।
সূর্য অস্ত গেছে। মহুয়া বললো, ফেরা যাক এখন, পেণ্ড। অনেকদূর এসে পড়েছি, বাড়ি পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে।
আর একটু গিয়েই ফিরবো আমরা। ওই সামনের বাঁকটায় গেলেই দেখতে পাবেন, আমাদের এখানকার সবচাইতে আশ্চর্য জিনিস। পেণ্ডা দ্রুত হাঁটে।
বাঁকটায় পৌছেই আশ্চর্য হয়ে গেল সবাই। সামনে বিরাট মাঠ, এপার থেকে ওপার দেখা যায় না। যতদূর দৃষ্টি যায়, কেবল মাঠ আর মাঠ। গমের চাষ করা হয়েছে সে মাঠে। এখন গম পাকবার সময়। সোনালি হয়ে গেছে সমস্ত মাঠ। দূরে একটা গিরিশৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে। মাথায় তার জমে আছে বরফ। সূর্যের আলো পড়েছে বরফের ওপর। মনে। হচ্ছে যেন পাহাড়ের মাথাটা ধক্ ধক্ করে জ্বলছে। সে পাহাড় থেকে একটা মিষ্টি আলো চারদিকে একটা ছড়িয়ে পড়ে স্বপ্নের আবেশ মেখে দিয়েছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। বিস্তার আর উচ্চতা ঠিক এমনভাবে বোধহয় আর কোথাও একত্র মেশেনি। এখানে এসে দাঁড়ালে মনটাও হয়ে ওঠে প্রশস্ত, আর বৃহৎ।
অনেকক্ষণ কামাল আর মহুয়া মােহগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। পাহাড়ের ওপরের আলোটা ধীরে ধীরে কমে আসছে। কারও কোনদিকে খেয়াল নেই।
অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে পেণ্ডা বললো, চলুন, ফেরা যাক।
চলুন। নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলে কামাল। কিন্তু ফিরতে তার মােটেই ইচ্ছে করছে না। এ সৌন্দর্যের যতটুকু পারে পান করে নিতে চায় সে।
ধীরে ধীরে তারা বাড়ির দিকে চললো। বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। কামাল বললো, এতো সুন্দর জায়গা, বিকেল বেলা কেউ বেড়াতে আসে না কেন?
সময় পেলে তো মানুষ আসবে। কেবল খেয়ে বেঁচে থাকবার চেষ্টাতেই এখানকার সব লোকের সময় চলে যায়। আমাদের দেশটা বড় গরীব। সব কিছুই শুষে নিচ্ছে ইংরেজ। সৌন্দর্য বোধটুকুও আর নেই। পেণ্ডার গলাটা কেমন যেন একটু ভারি হয়ে আসে। একটু কৃত্রিম হাসি হেসে বললো, কিন্তু আমার তো জীবন-সংগ্রাম নেই, তাই আমি প্রায়ই আসি এখানে সৌন্দর্য উপভােগ করতে, পয়সার অভাব না থাকলে জীবনে কতো রস ভােগ করা যায়।
কামাল মনে মনে আশ্চর্য হলো। এতো বোঝে এই কচি মেয়েটা! এর চোখ খোলা। সব কিছুই পরিষ্কার করে দেখবার ক্ষমতা আছে এর! কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কামাল বললো, আচ্ছা, পেণ্ডা মানে কি?
পেণ্ড। মানে? একটু হেসে বললো, পেণ্ডা মানে ভালবাসা। হ্রদটার পাশ দিয়ে চলতে মহুয়ার খুব ভয় করছে। সে পেশুকে জিজ্ঞেস করলো, যে কোনো মুহূর্তে আমাদের একজনকে তো কুমীরে ধরে নিয়ে যেতে পারে, তাই না?
কি বললেন? কুমীর? না। ডাঙার ওপর ওরা আক্রমণ করে না। মানুষের সাড়া পেলে আরও ঝুপঝুপ জলে লাফিয়ে পড়ে। অবশ্য এমনও দেখা গেছে, একলা নিরস্ত্র পেয়ে ডাঙার ওপরেও মাঝে মাঝে আক্রমণ করেছে মানুষকে। কিন্তু তিন-চারজন দেখলে ওরা কখনও এগোয় না। আসলে কুমীর জাতটা অত্যন্ত ভীতু। ঠিক বড় লোকদের মতো।
হ্রদটা ছাড়িয়ে এলো তারা। আঁকাবাঁকা পথ। পথের দুপাশটায়-মাঝে মাঝে অনেকগুলো বড় বড় গাছ আছে। জায়গাটা ঘন অন্ধকার। তারপর আবার ফাঁকা।
গফুর বেশ একটু পিছিয়ে পড়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে ধীরে ধীরে আসছে। যাতে হারিয়ে না যায় তার জন্যে সে ভালো করে নজর করে দেখেছে মাঝে মাঝে কামালদের। পথ হারিয়ে ফেললে ও আর বাড়ি ফিরতে পারবে না। দাদামণিরা ইংরেজিতে কথা বলে ওদের সাথে, কিন্তু সে তাও জানে না। এখানকার একটা ব্যাটাও বাংলা বোঝে না।