থানার ঠিক উল্টো দিকেই তার এক বন্ধুর বাড়ি। জানা দরকার সে এখানেই আছে না ঢাকায় গেছে। সে থাকলে বড় উপকার হবে। সোজা গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লো শহীদ। বেরিয়ে এলো একজন যুবক। দেখতে অত্যন্ত রোগা পটকা। তাই বয়স খুব কম বলে মনে হয়। চোখে চশমা, হাতে একটা বই। জিজ্ঞেস করলো, কাকে চান?
প্রফেসার আশরাফ চৌধুরী আছেন?
আমিই আশরাফ চৌধুরী। আপনার কি দরকার, ভিতরে আসুন না।
আমার নাম অনাথ চক্রবর্তী। রায়পুরার জমিদার। ঢাকার ইসলাম খান সাহেবের ছেলে শহীদ খান আমাকে আপনার সাথে আলাপ করতে উপদেশ দিয়েছেন।
আপনি বসুন না, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? তা কেমন আছে শহীদ। প্রায় বছর খানেক হলো ওর সাথে আমার দেখা নেই। মাঝে শুনেছিলাম গোয়েন্দাগিরি করছে, এখনও তাই?
হ্যাঁ, এখনও তাই। গোয়েন্দাগিরি করতেই সে এখন কুষ্টিয়ায় এসেছে এবং তোমার সামনের চেয়ারে বসে আছে হাঁদারাম!
এ্যাঁ। আপনি? মানে তুমি? আমি চিনতেই পারিনি।ভালো৷ ছদ্মবেশ ধরেছো তো হে, উঠেছে৷ কোথায়?
আদর্শ হিন্দু হোটেল।
বাদ দাও তোমার হোটেল। চলো এখনই জিনিসপত্র নিয়ে আসি আমার এখানে। কুষ্টিয়ায় এলে অথচ আমার বাসায় উঠলে না, আমি ভীষণ অসন্তুষ্টি হয়েছি।
দেখো ভাই বিশেষ কাজে খুনী তাড়া করে এসেছি, তাই হোটেলে উঠতে বাধ্য হয়েছি। নইলে তোমার এখানেই উঠতাম। আপাততঃ আমাকে হিন্দু জমিদার হয়ে থাকতে হবে। তুমি কিছু মনে করো না।
বেশ তো, এখন থাকো। কিন্তু কাজ হয়ে গেলে আমার এখানে কদিন বেড়িয়ে না গেলে আমি অত্যন্ত রাগ করবো।
আচ্ছা, আচ্ছা। আপাততঃ তুমি আমাকে কিছু খবর দাও দেখি। এখানে বিক্রি হবে এমন জমিটমি আছে?
খুব আছে। আমরাই তো কিছু জমি বিক্রি করবো। কেন কিনবে নাকি?
না, কিনবার-ভান করবো। আমি তো হিন্দু জমিদার। জমি কিনতে এসেছি। তোমাদের জমি থাকায় ভালোই হলো। তুমি মাঝে মাঝে জমির দলিল, নক্সা, পরচা ইত্যাদি নিয়ে আমার ওখানে যেতে পারবে, আমিও পারবো আসতে। তোমার কাছ থেকে অনেক খবর জানবার প্রয়োজন হবে। এখন চলি।
তুমি ঠিকানা দিয়ে যাও, আমি যাবো।
শহীদ একটা কাগজে নাম ঠিকানা লিখে আশরাফ চৌধুরীর হাতে দিলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, তুমি কাল বিকেলের দিকে একবার যেও আমার ওখানে।
এখনি উঠছো নাকি? চা-টা খাবে না?
না ভাই, আর বসবো না। কতকগুলো কাজ পড়ে রয়েছে।
হোটেলে ফিরে চিঠি লিখতে বসলো শহীদ। লীনাকে লিখলো যেন কিছুমাত্র চিন্তা না করে। সে, কামাল ভাই, গফুর সবাই খুব ফুর্তিতে রয়েছে। দিন পনেরোর মধ্যে ফিরবে।
কামালকে লিখলো, আমি যখনই টেলিগ্রাম করবো তখুনি তুই গফুরকে নিয়ে ছদ্মবেগে চলে আসবি কুষ্টিয়ায়। হিন্দু সেজে আসবি। আমি এখন রায়পুরার জমিদার অনাথ চক্রবর্তী। তুই আমার নায়েব অবিনাশ সেরেস্তাদার আর গফুর পেয়াদা। ওকে সব বুঝিয়ে দিবি আগে ভালো করে। কুষ্টিয়া আদর্শ হিন্দু হোটেল, গড়াই নদীর পাড়…
সেই বেটে চাকরটার হাতে চিঠি দুটো দিয়ে একটা আধুলী গুজে দিলো শহীদ। সে জিজ্ঞেস করলো, বাবু, লাল বাক্সে ফেলাবো, না নীল বাক্সে?
লাল বাক্সে ফেলে দাও। এখুনি যাও। জরুরী চিঠি।
সে চলে গেল চিঠি নিয়ে। শহীদ ভাবতে লাগলো, আজকের মতো কাজ শেষ। বিকেল বেলা নদীর পাড় ধরে গিয়ে যতদূর সম্ভব দেখে আসতে হবে।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে অর্ধেক পড়া ইংরেজি উপন্যাসটা নিয়ে ব্যালকনির একটা ইজিচেয়ারে গিয়ে বসলো শহীদ। উত্তর দিক থেকে ফুরফুরে একটা ঠান্ডা বাতাস আসছে। বেশ ভালো লাগে। মনটা কিছুতেই বইয়ে বসতে চায় না। বই বন্ধ করে সে সামনের দিকে চেয়ে রইলো।
নদীর জল অনেক শুকিয়ে গেছে। পাড় খুব উচু— যেন চোয়ালের হাড় বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু এই জলেও অনায়াসে স্টীমার চলতে পারে। ছোটো বড় হরেক রকম নৌকো চলছে। কারও পাল তোলা, কেউ বা দাঁড় টানছে। অনেক দূরের পাল তোলা গয়না নৌকো দেখলেই মনটা উদাস হয়ে যায়। দূরের টান– মাঝিদের অলস কথাবার্তা–জলের একটানা শব্দ- হালের বিলম্বিত ক্যাচ-কুচ শব্দ– খরা-আমেজ -দুপুর-সবটা মিলিয়ে স্বপ্ন মনে হয়।
বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো শহীদ। সেখান থেকে বাইরের দিকে চেয়ে রইলো চুপচাপ। আকাশে একবিন্দু মেঘ নেই। কয়েকটা চিল অনেক উচুতে উড়ে বেড়াচ্ছে। চারিদিকে একটা নিঝুমতা। দূরে কোনও একটা বাড়ির ছাত পেটানো হচ্ছে। সেই একটানা শব্দ দুপুরকে আরও গম্ভীর করে তোলে। হঠাৎ একটা কাক কর্কশ স্বরে ডেকে ওঠে। খান খান হয়ে যায় নিস্তব্ধতা। আবার জমে ওঠে আমেজ। ঝিমিয়ে আসে শহীদ। দুপুর এতো সুন্দর হতে পারে তার ধারণাই ছিলো না। একটা মধুর আমেজ তার বুদ্ধিক ছেয়ে ফেলে। এ দুপুরকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়, বুদ্ধি দিয়ে নয়।
বিকেল বেলা একটা শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল শহীদের। হরিদাস চা নিয়ে এসে রাখলো। চোখ কচলে উঠে বসলো শহীদ। ঘুমিয়ে পড়েছিল ভাবতে তার লজ্জাই লাগছে। দুপুরে ঘুমোনো ওর অভ্যেস নেই। দিবা-নিদ্ৰাকে রীতিমত ঘৃণাই করে সে। আর আজ নিজেই পাকা তিনঘন্টা দিবা-নিদ্রা দিয়ে উঠলো। কিন্তু এ অপরাধের জন্য তার গ্লানি নেই। শরীর মন বড় চাঙা বোধ হচ্ছে।
চা খেয়ে সে বেরিয়ে পড়লো নদীর পাড়ে বেড়াতে। সরু একটা রাস্ত৷ বরাবর নদীর পাশ দিয়ে চলে গেছে। বিকেলে আজকাল কেউ বড় একটা এদিকে আসে না। সবাই যায় পুলিশ গ্রাউন্ড কিম্বা কলেজ গ্রাউন্ডে হকি ক্রিকেট খেলা দেখতে। দুচারজন অতি-বৃদ্ধকে দেখা গেল নদীর নির্মল বায়ু সেবন করছেন। কেউ কেউ কোনও পাথরের পর কি গাছের গুড়িতে বসে আছেন। পথ ধরে কিছু উত্তরে গিয়ে শহীদ দেখলো একজন যুবক একটা পাথরের উপর বসে ওপারের চড়ার দিকে চেয়ে রয়েছে। কাছে যেতেই তার দিকে ফিরে চাইলো। তারপর আবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো ওপারে। শহীদ দেখলো, অদ্ভুত সুন্দর দুটি চোখ। নিস্পাপ, নিষ্কলঙ্ক। চোখের দিকে চাইলে মনে হয় কতো গভীর যেন মানুষটি, যেন সাগর। কতো কি তার অতল তলে আছে লুকোনো। কবি হওয়া এরই সাজে। মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল। পরনে জিনসের সাদা প্যান্ট আর হালকা গোলাপী রঙের শার্ট। বড়ো মানিয়েছে এই পড়ত বেলায় লোকটাকে এই কাপড়ে। বয়স ঠিক আঁচ করা যায় না- বোধ হয় তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে হবে। লম্বা-চওড়া শরীরের গড়ন। চওড়া উচু বুক শার্টের উপর দিয়েও স্পষ্ট অনুভব করা যায়।