ইন্টার ক্লাস থেকে একজন বাঙালী হিন্দু ভদ্রলোক নামলো। একটা চামড়ার বাক্স কুলির মাথায় তুলে দিয়ে এগিয়ে গেল ভদ্রলোক টিকেট চেকারের দিকে।
প্ৰথম দৃটিতেই বোঝা যায় সৌখিন লোক। দামী আদির পাঞ্জাবীর হাতা কিছুটা গোটানো। বোতামগুলো সোনার, চকচক করছে। একটু কুজো হয়ে হাঁটছে ভদ্রলোক। কিন্তু হাতের পেশী দেখে বোঝা যায় কি অসাধারণ শক্তি ছিলো তার যৌবনে। এখনও দুতিনজন ষন্ডামার্কা লোক তার সাথে লাগতে গেলে যথেষ্ট চিন্তা করে নেবে। টিকেট দেখিয়ে ভদ্রলোক বাইরে এসে একটা রিক্সায় চাপলো। বললো, আদর্শ হিন্দু হোটেল।
বাবু, তিনটে আছে হিন্দু হোটেল। কোনটায় যাবো?
গড়াই নদীর পাড়েরটায়।
রিক্সাওয়ালা বুঝলো এ লোক নতুন নয়। সে সোজা রিক্সা টেনে চললো। সেখান থেকে মিনিট দশেকের পথ। দোতলা হোটেল। একটা সাইনবোর্ড টাঙানো, তাতে লেখাঃ আদর্শ হিন্দু হোটেল ও রেন্টুরেন্ট।
হোটেলের ম্যানেজার সাগ্রহে এগিয়ে এলো। দোতলায় নদীর ধারের বেশ বড় একটা ঘর ঠিক হলো। সাথে বাথরুমও আছে অ্যাটাচ্ড্। একটা ডবল বেড খাট ঘরটার প্ৰায় আধখান জুড়ে। আসবাবের মধ্যে একটা টেবিল, তার চারধারে চারটে চেয়ার পাতা। ঘরের কোণে একটা মাঝারি আকারের ডেসিং টেবিল। পূর্বদিকে একটা ছোটে ব্যালকনি। সেখানে দুটো ইজিচেয়ার পাতা নদীর দিকে মুখ করে। বেশ পছন্দ হয়েছে এ ঘরটা বোঝা গেল ভদ্রলোকের মুখ দেখে। ম্যানেজার একটা খাতা খুলে জিজ্ঞেস করলো, মশায়ের নাম কি লিখবো?
লিখুন অনাথ চক্রবর্তী।
পেশা?
জমিদারী।
আজ্ঞে কি কারণে আগমন? সবিনয়ে জিজ্ঞেস করে ম্যানেজার।
এখানে একটা জায়গা কেনার ইচ্ছে আছে।
কি যেন লিখলো খাতায় ম্যানেজার। তারপর সই করিয়ে নিয়ে খাতা বন্ধ করে ভালো করে চাইলো অনাথ চক্রবর্তীর দিকে। বললো, আজ্ঞে, খাওয়া সম্বন্ধে চিন্তাও করবেন না। আমাদের পাচক ব্রাহ্মণ। আপনার কোনো অসুবিধে হবে না। এখানে এই হোটেলই সব চাইতে ভালো। বড় বড় লোক সবাই এখানেই পদধূলি দান করেন। আপনার কোনও কিছুর প্রয়োজন হলেই আমাকে খবর দেবেন। আমার নাম আজ্ঞে, দিবাকর শর্মা।
এ শহরে বছর দশেক আগে একবার এসেছিলাম। এখন দেখছি অনেক পরিবর্তন।
আজ্ঞে হয়েছেই তো! আমূল পরিবর্তন হয়েছে। আগে তো ভয়ানক নির্জন ছিলো এসব জায়গা। লোকালয় ছিলো ঐ মোহিনী মিলের কাছটাতেই। এখন এদিকেও কতো নতুন বাড়ি উঠলো আরও কতো হচ্ছে। আমি আজ্ঞে প্রায় বিশ বছর হলো এখানে এসেছি। আমার বাড়ি হলো গিয়ে কেশনগর।
ও। আচ্ছা আপনি আমার খাবার পাঠিয়ে দিন, আমি স্নান সেরে নিই। কলে জল আছে না?
আজ্ঞে আমাদের কলে সব সময়ই জল থাকে। আমরা পাম্প করে সাধারণ ব্যবহারের জল ট্যাঙ্কে তুলে রাখি। কিন্তু আজ্ঞে, নতুন জল, স্নান আজ অবেলায় না করলেই পারতেন।
দেখুন আমি খুব ক্লান্ত। স্নান করে কিছু মুখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। আপনি তাড়াতাড়ি আমার খাবার বন্দোবস্ত করুন। আমার এমন স্নান করা অভ্যেস আছে, কোনও ক্ষতি হবে না।
বাথরুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক একটু মুচকি হাসলো। ভদ্ৰলোক আর কেউ নয়, আমাদের শহীদ খান।
স্নান সেরে আবার অনাথ চক্রবর্তী সেজে সে বেরিয়ে এলো। টেবিলে তার খাবার সাজানো রয়েছে। তাই খেয়ে কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করছে, এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো। বাইরে থেকে আওয়াজ এলো, এটো বাসন নিতে এয়েছি কত্তা।
দরজা খুলে দিতেই একজন খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা ছুঁচোমুখো কুঁজো বেঁটে লোক একটা ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। পরিপাটি করে গুছিয়ে বাসন পেয়ালা তুলে সে অনাথ বাবুকে একটা নমস্কার করে চলে গেল। দরজা বন্ধ করে শহীদ খাটে এসে শুয়ে পড়ল।
নানান কথা মনে ঘুরপাক খেতে লাগলো। ট্রেনের সেই লোকটাকে খুঁজে বের করে তার উপর নজর রাখতে হবে। নদীর উপর নজর রাখতে হবে। কুয়াশাকে খুঁজে বের করার সূত্র সে পেয়েছে, তাই ধরে সে এগিয়ে যাবে। বেশ কিছুদিন থাকতে হবে তার এখানে। জেদ চেপে গেছে শহীদের, যে করে হোক ধরতেই হবে খুনীকে। যতো বড় ধুরন্ধরই সে হোক না কেন, অন্যায় শেষ পর্যন্ত ধরা পড়বেই। শহীদ হাসলো। কুয়াশার অনুচর ভাববে শহীদ আর কামাল এখনও গোয়ালন্দেই আছে।-এই শেষের লাশটারও হার্ট পাওয়া যায়নি। এমন অদ্ভুত ব্যাপার শহীদ আর কখনো শোনেনি। এক্স-রে দিয়ে ফটো তুলে ভেতরের খবর জানতে পারা আজ সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু উপরের চামড়ায় আঁচড়টুকু না দিয়ে হার্টটা কি করে গলিয়ে ফেলা যায়? অদ্ভুত বুদ্ধিমান এই খুনী। বুদ্ধির পরিচয় এর প্রতিটা কাজেই পাওয়া যাচ্ছে। দলবলও আছে লোকটার।
এসব নানান কথা এলোমেলো ভাবে তার মনে হতে লাগলো। সারারাত ভালো ঘুম হলো না। কানের কাছে মশার গুঞ্জন, মনে নানারকম চিন্তা নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইলো শহীদ।
অনেক বেলা করে পরদিন ঘুম ভাঙলো তার। চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লো সে। পোস্ট অফিস থেকে গোটাকতক খাম কিনলো। তারপর থানার দিকে হাঁটতে থাকলো।
কুষ্টিয়ার রাস্তাঘাট বেশ ভালো। চিনতে কষ্ট হয় না। সবগুলোই সোজা সোজা। মেইন রোড থেকে অনেকগুলো রাস্তা লম্বাভাবে বেরিয়ে গিয়ে নদীতে পড়েছে। বাড়িগুলো রাস্তার পাশে সাজানো। মফঃস্বল টাউন। একটা গ্রাম্য পরিবেশের ছোয়া পাওয়া যায়। টাউনটা খুবই ছোটো, কিন্তু কিছুরই অভাব নেই। ষ্টেশন দুটো, একটা কুষ্টিয়া অপরটা কুষ্টিয়া কোর্ট, মাইল খানেকের তফাত। জজ কোর্ট, কোর্ট স্টেশনের সাথেই লাগানো। তার উত্তরে পুলিশ ব্যারাক। স্টেশনের পশ্চিমে কুষ্টিয়া কলেজ। তার সাথে লাগা কলেজ ফুটবল গ্রাউন্ড। হাসপাতালটা হচ্ছে গার্লস স্কুলের পাশেই, তার উত্তরে বয়েজ স্কুল। দুইটা সিনেমা হল রয়েছে এইটুকু শহরে।