ওসব চিন্তা এখন রাখ তো। কাল সারাদিন অনেক কাজ আছে, এখন একটু ঘুমিয়ে নে।
এই বলে দুই ঢোকে কফিটুকু শেষ করে শহীদ খাটের তলায় রেখে দিলো কাপটা। তারপর বিছানায় শুয়ে কল টেনে দিলো গলা পর্যন্ত। কামালও তার বিছানায় ঢুকলো। অনেকক্ষণ পর্যন্ত কারো চোখে ঘুম এলো না।
৬.
গোয়ালন্দ থানার দারোগা কামালের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। শহীদ আর গফুরকে নিয়ে অসঙ্কোচে তার বাড়িতে গিয়ে উঠলো কামাল। তমিজউদ্দিন মোল্লা অত্যন্ত অমায়িক লোক। খুব খাতির করলেন ওদের। দারোগা হিসেবে এখানে খুব হাঁক ডাক আছে। মাছ, দুধ, ঘি, ফল ইত্যাদি বিনা পয়সায় প্রচুর পরিমাণে তার বাড়িতে আসে; টাকা পয়সা তিনি মোটেই নেন না, সেটা হারাম। স্টীমার ঘাট থেকে বাড়িটা সিকি মাইল মতো হবে।
বেলা বারোটার দিকে স্টীমার ঘাটে একটা গোলমাল শোনা গেল। তমিজ সাহেবের মুখটা সহসা গম্ভীর হয়ে গেল। কামাল ও শহীদ আশ্চর্য হয়ে গেল তাঁর এই পরিবর্তন দেখে। কামাল প্রশ্ন করলো, গোলমাল কিসের?
তমিজ সাহেব কুচকে বললেন, কি জানি? আবার হয়তো লাশ পাওয়া গেছে নদীতে। কিছুদিন যাবত কয়েকদিন পর পর লাশ পাওয়া যাচ্ছে নদীতে। এমন আর এই এলাকায় হয়নি। বড্ডো ঝঞ্ঝাটে পড়েছি। এখন লাশ আবার পাঠাতে হবে রাজবাড়ি, পোষ্ট মর্টেমের জন্যে। সাথে আবার তার পুলিশ দাও। এই এলাকায় একেবারে প্যানিক সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। মাঝখান থেকে আমার অবস্থা কাহিল। ওপরআলা চাপ দিচ্ছে ইনভেস্টিগেশন করো। আরে বাবা, ইনভেস্টিগেশন কি পানির তলায় করবো? নদীর কোন জায়গায় ইনভেস্টিগেশন করা যায় বলেন তো, শহীদ সাহেব!
এমন সময় কয়েকজন লোক একটা লাশ এনে দারোগা সাহেবের উঠানে ফেললো। লাশ দেখেই কামাল শহীদের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। শহীদ নির্বিকার ভাবে এগিয়ে গেল মড়ার কাছে।
একটা বারো-চোদ্দ বছরের ছেলে। মুখটা এমনভাবে কোনও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কাটাকুটি করা যে সনাক্ত করা অসম্ভব।
তমিজ সাহেবের দিকে ফিরে শহীদ বললো, মি. তমিজউদ্দিন, আপনি পোস্ট মর্টেমের কোনো রিপোর্ট পেয়েছেন? আগের লোকগুলো কিভাবে খুন হয়েছে বলে ডাক্তার রিপোর্ট দিয়েছে?
দুটো লোকই এক আশ্চর্য উপায়ে খুন হয়েছে। বললে বিশ্বাস করবেন না, লাশ দুটোর হার্ট গলিয়ে ফেলা হয়েছে। শরীরের উপরে বুকের কাছে কোনও কাটাকুটির চিহ্ন নেই। শরীরের ভেতর থেকে আর কিছুই পাওয়া যায়নি। বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা? শরীরের ওপর কোনো ক্ষত নেই অথচ হার্টটা বেমালুম গলে গেল।
রিপোর্টটা পেলেন কবে?
আজই সকালে। আমি একেবারে তাজ্জব হয়ে গেছি রিপোর্ট পড়ে। এগুলো কিন্তু টপ সিক্রেট ব্যাপার। আপনি দয়া করে এগুলো বাইরে প্রকাশ করবেন না। তাহলে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি আরম্ভ হবে।
সত্যি কথা বলতে কি তমিজ সাহেব, আমি এই কেসটা নিয়েই ঢাকা থেকে এসেছি। আমার সঙ্গে আই. জি. সাহেবের চিঠি আছে। আপনি যদি দয়া করে আমাকে রিপোর্টটা দেখতে দেন তো বড় ভালো হয়।
আচ্ছা! -আশ্চর্য হয়ে যান তমিজ সাহেব।–আপনারা তা হলে এই ব্যাপারেই এসেছেন! ওপরআলাদের নজর ভালো মতোই পড়েছে এই দিকে! এবার আমার চাকরিটা গেল বুঝি।
না মি. তমিজ, আমরা অন্য কেসে এসেছি-নানা অবস্থায় শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে আমাদের আসামী আর আপনার আসামী একই ব্যক্তি। আপনার ভয়ের কোনো কারণই নেই। ওপর-ওয়ালারা জানেই না যে এই দুই কেসের আসামী একই লোক।
তাদের জানবার আগেই কেসটার একটা সমাধান করে ফেলুন না?
তার জন্যে আপনার সহযোগিতা আমার একান্ত প্রয়োজন।
আপনার সব রকম সাহায্যের জন্যেই আমি প্রস্তুত বলুন, কি সাহায্যের দরকার?
আপাততঃ পোস্ট মর্টেমের রিপোর্টটা দেখাতে হবে।
তমিজ সাহেব একজন সেপাইকে ডেকে অফিস থেকে রিপোর্টের ফাইলন্টা আনতে হুকুম করলেন। শহীদ জিজ্ঞেস করলো, এ লাশ কখন পাঠাবেন রাজবাড়ী?
দেড়টার সময় একটা মিক্সড ট্রেন আছে। আর ঘন্টাখানেক বাকি।
আমি ছদ্মবেশে সাথে যাবো। আমাকে একটা পুলিশের ইউনিফরম দিতে হবে।
ঘরে ফিরে এসে শহীদ কামালকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললো, আমি আপাততঃ রাজবাড়ী যাচ্ছি। আমি যেখান থেকেই চিঠি বা টেলিগ্রামে খবর দিই, সটান ছদ্মবেশে সেখানে চলে যাবি। আর আমি যে এখানে নেই তা যেন কেউ যুণাক্ষরেও টের না পায় গফুরকে আমার মতো করে সাজিয়ে মাঝে মাঝে গোয়ালন্দের আশেপাশে ঘুরে বেড়াবি খুব চিন্তিত মুখে। মাঝে মাঝে নদীতে নৌকো করে যাবি। মাঝিদের জিজ্ঞেস করবি কোথায় লাশ পাওয়া গিয়েছিল। খেয়াল রাখবি, আমি যে নেই তা যেন কেউ লক্ষ্য না করে। ভোর চারপাশে অনেক ছায়া দেখবি-বুঝেও বুঝতে চাইবি না যে তুই ওদের স্পাইং টের পেয়েছিস।
আধঘণ্টা পর কয়েকজন পুলিশ লাশ নিয়ে সোজা স্টেশনের দিকে চলে গেল।
৭.
কুষ্টিয়া কোর্ট।
লাল স্টেশন ঘরটার গায়ে বড় বড় সাদা হরফে লেখা। সন্ধ্যা একটু ঘনিয়ে এসেছে। ট্রেন এসে থামলো। কয়েকজন যাত্রী নামলো। এদিকটা নিরালা-এরই মধ্যে সব নিঝুম হয়ে এসেছে। ছোটো স্টেশন ঘরটার পাশেই একটা চায়ের স্টল। বাতি জ্বলছে। কয়েকজন লোক বসে আছে বেঞ্চির উপর। কেউ বেঞ্চির উপর পা তুলে চাদর মুড়ি দিয়ে একেবারে জমে বসেছে। দোকানদার ঠক ঠক করে তাদের সামনে চায়ের গেলাস রাখছে।