তোমরা কিছু খাবে, দাদামণি?
এতো রাতে আবার কি খাওয়াতে চাস? অবাক হয় শহীদ।
ককি বানিয়ে দেব?
কফি বানাবি মানে? কোথায় বানাবি? কি করে বানাবি?
গফুর গম্ভীর ভাবে বলে, সব কিছুই আমি সাথে করে এনেছি।
সাবাস গফুর, এতো গোলমালের মধ্যেও তোর ছোটোখাট কথা মনে থাকে!
প্রশংসায় কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে গফুর বললো, তোমার একলার জন্যে বানাবো, না কামাল ভাইও খাবে?
ওকে আর জাগাস না। বেচারার সর্দি লেগে গেছে। এখন একটু ঘুমোচ্ছে ঘুমিয়ে নিক।
এই কথা বলতেই পাশ ফিরে গফুরের দিকে চেয়ে একটা মনোরম হাসি দিয়ে কামাল আবার ঘুরে শুলো।
আর কোনো কথা না বলে গফুর নিজের কাজে লেগে গেল।
বছর কয়েক ধরে দাদামণির মাথায় যে কি ভূত চেপেছে, তাই নিয়ে গফুরের খুবই চিন্তা হয়। গম্ভীর ভাবে সে গত দুবছর ধরে দাদামণির কার্যকলাপ লক্ষ্য করে আসছে। তাতে চিন্তা তার বাড়ছে বই কমছে না। কিছুদিন যাবত সে শহীদকে চোখে চোখে রাখছে। গোয়ালন্দ যাবার কথা কিছুই শহীদ বলেনি গফুরকে। যেদিন রওনা হবে সেদিন গফুরকে একটু ব্যস্ত দেখা গেল। গোটা নয়েকের দিকে গম্ভীরভাবে শহীদকে বললো, ছোটো আপাকে কামাল ভাইদের বাড়ি রেখে এলাম।
আশ্চর্য হয়ে শহীদ জিজ্ঞেস করলো, কেন রে।
ছোটো আপা তো একা বাড়িতে থাকতে পারবেন না!
আরও আশ্চর্য হয়ে যায় শহীদ। কেন, তাকে একলা থাকতে হবে কেন?
গম্ভীরভাবে গফুর ঘোষণা করলো, আমি তোমাদের সাথে যাচ্ছি। এই কথা বলে আর কোনও কথা উঠতে না দিয়ে সে সরে গেল সামনে থেকে। শহীদ হাঁ করে খানিকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।
দুজনকে দুকাপ কফি দিয়ে গফুর চলে গেল। কামাল উঠে দরজা বন্ধ করে এলো। এমন সময় ঠক করে দরজায় একটা শব্দ হলো। দরজা আবার খুলতে যাচ্ছিলো কামাল। শহীদ লাফিয়ে উঠে ওকে ধরলো। তারপর বেশ জোরে ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করলো, কে!
কোনও জবাব নেই। আবার টোকার শব্দ হলো। আরও জোরে শহীদ জিজ্ঞেস করলো, কে?-এবারও কোনও জবাব নেই। কামাল একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। তাকে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে শহীদ প্রথমে নিঃশব্দে বন্টুটা খুললো, তারপর একটা কপাটের আড়ালে দাঁড়িয়ে আরেকটা খুলে ফেললো। সাথে সাথেই ঘরের ভিতর কাঠের দেয়ালে খট করে আওয়াজ হলো। ছোট্ট একটা তীর বিঁধে আছে দেয়ালে। দরজাতেও দুটো একই রকমের তীর বিঁধে আছে। বাইরে চাইলো শহীদ। কেউ কোথাও নেই, কেবল সামনে কিছু দূরে স্টীমার-ক্যান্টিনে একটা বেঞ্চির উপর একজন লোক আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।
তীর দুটো খুলে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো শহীদ। ঘরের দেয়ালে যে তীরটা বিঁধে ছিলো সেটাও খুলে আনলো।
ছ ইঞ্চি লম্বা। পিছনে অনেকগুলো নরম পালক। পালকের কাছটাতে একটা ছোট্ট চিঠি। শহীদের ঘাড়ের পাশ দিয়ে ঝুকে পড়লো কামাল চিঠিটার উপর। তাতে স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লেখাঃ
শহীদ খান,
তোমাকে আমি অনুরোধ করেছিলাম আমার কাজে বাধা দিয়ো না। তবু তুমি আমার পিছনে লেগেই রয়েছো। আমার শক্তি সম্বন্ধে ওয়াকেফহাল করবার জন্যে এটুকু করলাম। এ তীর চিঠি বয়ে নিয়ে গিয়ে তোমার বুকে একটু বিধেছে, যদি পটাশিয়াম সায়ানাইড বয়ে নিয়ে এটুকু বিধতো তবে কেমন হতো? আমার পক্ষে তা অসম্ভব নয়। অতএব, বন্ধু, ঘরে ফিরে যাও। নইলে পরে এমন বহু সুযোগই আমি পাবো যখন তোমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে কিছুমাত্র দ্বিধাবোধ করবো না। তোমার মতো বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে এর বেশি বলা বাহুল্য মনে করছি। ইতি–
কুয়াশা
শহীদ ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো চিঠিটা পড়ে।
কামাল বললো, কী সাংঘাতিক লোক দেখেছিস।
দেখলাম। বন্ধু একটু ভুল করেছে। মনে করেছে তীর সোজা এসে আমার বুকে বিধেছে।
বিধতোই তো! আমি তো মনে করেছিলাম দরজায় টোকা পড়ছে, গফুর এসেছে বুঝি। তুই বুঝলি কি করে, এ টোকায় সন্দেহ করবার কিছু আছে?
টোকার আওয়াজ শুনলেই চেনা যায়। একটা টোকার ফলে দরজায় কখনও ঘরর শব্দ হয় না।
তুই বাইরে কাউকে দেখলি না?
একজন লোক বেঞ্চির উপর শুয়ে ছিলো কষল মুড়ি দিয়ে।
ও-ই বোধকরি তীর মেরেছে।
বোধকরি কেন, আমার স্থির বিশ্বাস ও-ই মেরেছে।
তাহলে তাড়া করে ধরলি না কেন? চল ব্যাটাকে ধরে পুলিশে দিই।
এখন কোনো লাভ নেই গিয়ে। দরজা খুলে দেখ কেউ নেই ওখানে।
কামাল দরজা খুলেই দেখলো সত্যিই কেউ নেই। শহীদ বললো, আমি দরজা খুলেই ওর কাছে ছুটে যেতে পারতাম। কিন্তু তাতে আহত হওয়া ছাড়া আর কোনো ফল হতো না। ওদের আরও লোক নিশ্চয়ই ছিলো কাছাকাছি নল হাতে করে। আমরা এগোলেই ঝাঁকে ঝাঁকে ঐ রকম ছোটে তীর এসে লাগতো।
নল হাতে থাকবে কেন?
এই তীরগুলো ধনুক থেকে ছোড়া হয়নি। বর্ষায় পাখি শিকারের জন্যে এই রকম তীর ব্যবহার করা হয়।
টেকনাফ অঞ্চলে মগদের মধ্যেও এর ব্যবহার আছে। সরু একটা নলের মধ্যে এই তীর ভরে অন্যদিকে মুখ লাগিয়ে ফুঁ দিতে হয়। অনায়াসে তিরিশ চল্লিশ হাত দূরে এই তীর ফেলা যায় ফুঁ দিয়ে। অভ্যেস হয়ে গেলে পঞ্চাশ ষাট গজ পর্যন্ত যায়। তীরের আগায় থামোফোনের পিনের মতো একটা চোখা লোহা থাকে, পিছনে থাকে পালক। তাতে করে খুব ভালো সই হয়।
অদ্ভুত পদ্ধতি তো। লোহাটার আগায় সামান্য একটু বিষ মাখিয়ে নিলেই একটা মানুষকে অনায়াসে সাবাড় করে দেয়া যায়। কোনো শব্দ নেই। বন্দুকের চেয়ে মারাত্বক!