কামালের গভীর চিন্তানিত মুখের দিকে তাকিয়ে শহীদ হেসে ফেললো। বললো, আমরা রওনা হতে পারি মানে? আমি গোয়েন্দা মানুষ আমি যেতে পারি, কিন্তু তুই যাবি কোন দুঃখে?
ব্যঙ্গ করছিস, না দর্প করছিস বুঝতে পারছি না। কি ভেবেছিস? তোর পিছন পিছন খামোকাই ঘুরছি নাকি? আমি যাবো না মানে? একশো বার যাবো, যাবোই তো।
না, তুই আবার এসব গোয়েন্দাগিরি তেমন পছন্দ করিস না কিনা তাই বলছিলাম। যাকগে, যে খবরটার কথা তুই বলছিস, সেটা আমারও নজরে পড়েছে। আমি হক সাহেব আর অক্ষয় ব্যানার্জীর শরীরে কি কি চিহ্ন ছিলো, প্রথমে তাই জেনেছি। তারপর রাজবাড়ি হাসপাতালে ট্রাঙ্ককল করেছি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জানতে পেলাম প্রথম জনের ডান হাতের বুড়ো আঙুল কেটে ফেলা হয়েছিল, আর দ্বিতীয় জনের ডান পায়ের হাঁটুর কাছ থেকে খানিকটা মাংস কাটা ছিলো। হারুনের কাছ থেকে জানতে পারি তার কাকার ডান হাতের বুড়ো আঙুলের উপর মন্ত এক আঁচিল ছিলো। আর অক্ষয় বাবুর চাকরের কাছ থেকে জানতে পারি, প্রায় দেড় বছর যাবত তিনি হাঁটুর কাছে একটা দাদ হওয়ায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। অনেক পয়সা খরচ করেও সেটা সারানো যাচ্ছিলো না। এখন বুঝতেই পারছিস, আমাদের সন্দেহ শতকরা নম্বই ভাগ যুক্তিযুক্ত হয়েছে।
তাহলে চল না, আমরা গোয়ালন্দ রওনা হয়ে যাই।
দেখা যাক। আয় আপাততঃ শুয়ে পড়ি, রাত অনেক হয়েছে।
দুজনেই বিছানায় ঢুকে পড়েছে, এমন সময় কামালের চোখে পড়লো মাথার দিককার জানলার গরাদ ধরে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। সার্সির ওপারে লোকটার মুখ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। চমকে লাফিয়ে উঠে বসলো কামাল। চিৎকার করে উঠলো, কে ওখানে?
স্যাৎ করে সরে গেল মুখটা। বালিশের তলা থেকে রিভলবারটা নিয়ে বিদ্যুৎগতিতে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো শহীদ। জানালাটা খুলতেই দড়াম করে একটা পাথর এসে লাগলো শহীদের কপালে। উঃ করে একটা আর্তনাদ–শহীদ ঘুরে পড়ে গেল মাটিতে। কামাল ছুটে এসে ধরলো শহীদকে। বাইরে একটা মোটর স্টার্ট নেয়ার শব্দ পাওয়া গেল। কামাল চেয়ে দেখলো একটা গাড়ির পিছনের লালবাতি দুটো দ্রুত বেগে চলে গেল বড় রাস্তার দিকে।
৫.
সকাল বেলা কামাল ঘুম থেকে উঠে দেখলো শহীদ আলোয়ান জড়িয়ে গুটিদুটি মেরে বসে আছে চেয়ারে। চোখ বন্ধ। গভীর ভাবে কি যেন ভাবছে। মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। প্রকান্ড একটা হাই তুলে কামাল বললো, উঠলাম।
একটু চমকে উঠলো শহীদ। তারপর একটা খাম ওর দিকে ছুড়ে দিলো। বিছানার কাছে মাটিতে পড়লো খামটা। কুড়িয়ে নিয়ে খুলে ফেললো কামাল। ছোট এক টুকরো কাগজ। তাতে স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লেখাঃ
শহীদ খান,
তুমি আমার পেছনে লাগতে এসো না। আমি জানি, যদি কেউ কখনও আমার কাজে বাধা দিতে পারে, সে হচ্ছো তুমি। পুলিস বা তাদের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ -এর সাধ্য নেই আমার কেশাগ্র স্পর্শ করে। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, তুমি আমাকে বাঁধা দিয়ো না। যে টাকা আমি চুরি করেছি সে সমস্তই মানব-কল্যাণের উদ্দেশ্যে ব্যয় করা হচ্ছে। আর যে সব মানুষ আমি চুরি করেছি, তাদের লাগিয়েছি আমার গবেষণার কাজে। আর কদিন পর যখন পৃথিবী আশ্চর্য হয়ে যাবে আমার আবিষ্কার দেখে, যখন পৃথিবীর মানুষ প্রভূত উপকার পাবে সেই আবিষ্কার থেকে, তখন বুঝবে সামান্য কিছু টাকা আর কয়েকজন মানুষের প্রাণের বিনিময়ে আমি কতো বড় দান দিয়ে গেলাম পৃথিবীটাকে। ইতি–
কুয়াশা
কামাল চিঠিটা শেষ করে দেখলো শহীদ আবার চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানছে। সে বললো, চিঠিটা পেলি কোথায়?
আমাদের মশারীর উপর।
কি ঠিক করলি?
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে শহীদ বললো, একটা কথা জানিস, এই ধরনের লোকদের ওপর আমার বড় একটা দুর্বলতা আছে। আমি জানি, এমন কিছু বিষয় আছে যা নিয়ে গবেষণা করতে গেলে মানুষ খুন করতে হয়। অথচ সেটা বেআইনী। সামান্য একটু বেআইনী কাজ করলে হয়তো পৃথিবীর মস্ত বড় উপকার হয়, তবু তা করা যাবে না। যারা বিজ্ঞান-পাগল, তারা কোনও আইন মানে না। প্রয়োজন মতো মানুষ খুন করা এদের কাছে অতি সাধারণ কাজ।
কামাল কি যেন বলতে যাচ্ছিলো। শহীদ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, তাই বলে মনে করিস না আমি এই মানুষ খুন আর টাকা চুরির ব্যাপারে হাত গুটিয়ে বসে থাকবো। আমি এই পাগল বৈজ্ঞানিকের বিরুদ্ধে আমার সব শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বো।
একটানা এতগুলো কথা বলে। শহীদ চুপ করলো। কামাল বললো, আমিও তাই বুঝি। যে করে হোক এই লোককে ধরিয়ে দিতেই হবে পুলিশের হাতে।
নারায়ণগঞ্জ-গোয়ালন্দ ষ্টীমার চাঁদপুর ঘুরে যায়। বড়ো বেশি সময় লাগে তাতে। বেলা দুটোর সময় ষ্টীমারে উঠলে গোয়ালন্দ পৌছায় ভোর পাঁচটায়। সারাদিন হৈচৈ। টং টং করে নোঙর ফেলবার সময় শিকলের শব্দ। নানা রকম ফেরিওয়ালার ডাক। কলা, সন্দেশ, দৈ, রসগোল্লা, চানাচুর। অনেক রাতে স্টীমার একটু চুপ হয়। কেবল এঞ্জিনের একটানা শব্দ। মাঝে মাঝে কারো কোলের বাচ্চা কেঁদে ওঠে।
শহীদ আর কামাল সেকেন্ড ক্লাশ কেবিনে শুয়ে। বিকেলে স্টীমারের সামনের ডেকে চেয়ার পেতে বসেছিল ওরা। তাতে কামালের সর্দি করেছে। সে ঘুমোবার চেষ্টা করছে, আর শহীদ কি একটা মোটা ইংরেজি বই পড়ছে কম্বলটা দিয়ে পিঠ পর্যন্ত ঢেকে নিয়ে। এমন সময় কেবিনের দরজায় টোকা পড়লো। শহীদ দরজা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলো, কিরে গফুর?