শহীদ আগাগোড়া চিঠিটা পড়ে বললো, আপনাদের সাহায্য পাওয়া আমার পক্ষে মস্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার। এজন্য ধন্যবাদ।
এখন আপনার জন্যে কি করতে পারি?
আপাততঃ অক্ষয় ব্যানার্জির বাড়িটা ঘুরে ফিরে দেখবার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
এক্ষুণি স্লিপ দিয়ে দিচ্ছি। খশ খশ করে লিখতে লাগলেন লোকমান সাহেব। চিঠিটা নিয়ে শহীদ উঠতেই লোকমান সাহেব ব্যস্ত হয়ে বললেন, সে কী উঠছেন যে? চা আনতে বলেছি তো! একটু বসুন, চা খেয়ে যাবেন। এ… সিপাই, জলদি চায়ে লাগাও।
মাফ করুন, মি. লোকমান। আজ নয়, অন্যদিন এসে খেয়ে যাবো–উঠে পড়ে শহীদ।
শহীদের মরীস মাইনর যখন রাস্তায় চলে, তখন বাইরে না চাইলে বোঝাই যায় না চলছে কি দাঁড়িয়ে আছে। পুরোনো পল্টনে অক্ষয় বাবুর বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামলো। দুজন সেন্ট্রি হোটের সামনে দাঁড়ানো। স্লিপটা আর তার উপরকার সিলটা দেখে সেলাম ঢুকে পথ ছেড়ে দিলো তারা।
দোতলার উপর তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো একজন সেন্ট্রি। সুন্দর করে সাজানো গোছানো ঘরটা। অক্ষয় বাবুর আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। আজ বিশ বছর হয় তার স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি আর বিয়ে করেননি। ছেলেপুলে নেই, টাকা পয়সা আছে প্রচুর। একটা হাসপাতাল খুলেছেন তিনি বছর তিনেক হলো—সেখানে বিনামূল্যে প্রায় পাঁচশো রোগীর থাকার ব্যবস্থা আছে। এছাড়া অনেক স্কুল কলেজে তিনি প্রতি বছর মোটা টাকা দান করেন।
অক্ষয় বাবুর ঘরটার সাথেই পশ্চিম দিকে একটা ঝোলানো বারান্দা আছে। সেখানে একটা ইজিচেয়ার রাখা। বিকেলের পড়ন্ত রোদে গা-টা একটু গরম করবার জন্য অক্ষয় বাবু এখানে এসে বসতেন। ঘরের মধ্যে খোলা হাঁ করা রয়েছে একটা দেয়াল সিন্দুক। বিছানার কাছে একটা ছোটো টেবিলে কিছু বই-পত্র আর কয়েকটা মলমের কৌটো। বারান্দার দিকের একটা জানালার গরাদ বাঁকিয়ে উপর দিকে তোলা।
শহীদ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো, মযহারুল হক সাহেবের বাড়িতে যেভাবে লোহা গলানো হয়েছিল, ঠিক সেই একই পদ্ধতিতে এখানকার লোহাও গলানো হয়েছে।
পুলিস রাতে চাকরের ফোন পেয়ে এসে এ ঘরের দরজা ভেঙেছে। একজন চাকরের কাজ রাত তিনটের সময় অক্ষয় বাবুর জন্যে এক কাপ কফি করে তাকে ডেকে তোলা-তিনি তখন থেকে বাকি রাতটুকু পড়াশোনা করতেন। কিন্তু কাল অনেক ডাকাডাকি করেও তাকে ঘুম থেকে ওঠাতে না পেরে চাকর আর সবাইকে ডেকে তোলে। তারা অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কাধাকি করে পুলিসে ফোন করে। পুলিস এসে দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে।
শহীদ এতসব বৃত্তান্ত একটা চাকরের কাছ থেকে মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তাহলে অক্ষয় বাবু কোন পথে নিখোজ হলেনঃ একমাত্র পথ হচ্ছে বারান্দা। কেউ তাকে পিঠে বেঁধে নিয়ে রশি বেয়ে নিচে নেমে গেছে কিংবা তাঁকে রশিতে ঝুলিয়ে আগে মাটিতে নামিয়ে তারপর নিজে নেমে গেছে। তবে কি তাকে অজ্ঞান করে নিয়েছিল আগেই, নাকি খুন করা হয়েছিল।
আরও কয়েকজনের সাথে কথা বলে দেখলো শহীদ। কেউ নতুন কিছু বলতে পারলো না। চিন্তাক্লিষ্ট মুখে শহীদ নেমে গেল সিড়ি বেয়ে। পিছনে কামাল। কোনো কথা নেই কারো মুখে। আকাশ পাতাল কতো কি ভাবছে তারা। কোনও চিহ্নই পিছনে ফেলে যায়নি চোর।
৪.
চার পাঁচ দিন পার হয়ে গেছে। শহীদের শোবার ঘরে পা থেকে গলা পর্যন্ত ভালো করে আলোয়ান মুড়ি দিয়ে শহীদ আর কামাল রেডিয়ো শুনছে। কলকাতায় তানসেন সঙ্গীত সম্মেলন হচ্ছে-তারই রীলে শুনছে দুজন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনবার অত্যন্ত আগ্ৰহ উভয়েরই। মনের এই দিকটায় দুজনের অস্তৃত মিল। রবিশঙ্করের সেতার হচ্ছে। ললিত রাগে আলাপ চলছে। অপূর্ব সুন্দর বাজাচ্ছে। ঠিক মনের কথাটা সুর হয়ে বেরিয়ে আসছে যেন। শহীদ মনে মনে আওড়ায় তড়পত হু য্যয়সে জল বিন মীন। তন্ময় হয়ে গিয়েছে দুজন।
রাত সাড়ে-বারোটার দিকে বাজনা প্রায় শেষ হয়ে এলো। অতি দ্রুত লয়ে ঝালা চলছে, ঝালার মধ্যে ছোটো ছোটো গমক তান। তবলা প্ৰাণপণে বাজাচ্ছে, এ-ও যে সে নয়, চতুরলাল তবলুচি।
ঠিক এমনি সময়ে ক্রিং ক্রিং করে ড্রইংরুমে ফোন বেজে উঠলো। সমস্ত মুখটা বিরক্তিতে বিকৃত করে শহীদ উঠে গেল। ফোন বেজেই চলেছে। রাগ লাগে শহীদের।
শহীদ যখন ফিরে এলো তখন একটা লম্বা তেহাই দিয়ে শেষ হলো বাজনা। রেডিয়ো বন্ধ করে দিয়ে কামাল জিজ্ঞেস করলো, কিসের ফোন রে?
লোকমান সাহেব ফোন করেছিলেন। আবার আরেকখানে চুরি। মানুষও একজন গায়েব। ব্যাটারা পেলো কি বল দেখি? আমাকে যেতে বলছিলেন লোকমান সাহেব-আমি বলে দিলাম যাবো না।
যাবি না কেন?
কোনও লাভ নেই। কোনও সূত্র পাওয়া যাবে না সেখানে গিয়ে। শুধু শুধু হয়রানি এই শীতের রাতে।
কার বাড়িতে হামলা হলো এবার?
রোকনপুরের ডক্টর ইখতিয়ার আহমেদের বাড়িতে। ভদ্রলোক এম. আর. সি.পি.। ঠিক একই ভাবে শিক বাকিয়ে চোর ঢুকেছিল। নিখোঁজ হয়েছে ডাক্তারের বারো বছরের ছেলে।
কিন্তু কি আশ্চর্য! বার বার চোর অবলীলাক্রমে নিজের কাজ সারছে, কোনওকিছুই করা যাচ্ছে না। এর কি কোনও প্রতিকার নেই?
কি জানি। কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
আমার কিন্তু একটা ব্যাপারে সন্দেহ হয়। তোকে এতোদিন বলিনি। একটা ক্ষীণ আশার রেখা হয়তো পাবি। এই দেখ দুইটা দিনের খবরের কাটিং। প্ৰথম নিখোঁজের ঠিক তিন দিন পর এটা বেরিয়েছিল। আর দ্বিতীয় নিখোঁজের তিনদিন পর এই-টা। একই ভাবে দুদুটো মৃতদেহ পাওয়া যাওয়ায় গোয়ালন্দে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এবার তিনদিন পর যদি আরেকটা মৃত্যু সংবাদ পাওয়া যায় তাহলেই নিশ্চিন্ত মনে আমরা কোয়ালন্দ রওনা হতে পারি, কি বলিস?