রাজবাড়ীতে সত্যিই আমি পাথর ও লাশ ওজন করেছিলাম। ছেলেটির স্বাস্থ্য যে রকম, তাতে তার স্বাভাবিক ওজন কতো ছিলো তা ডাক্তার আন্দাজ করে বলেছিলেন। আমি অঙ্ক কষে বের করলাম পাথরটা নিয়ে ভেসে উঠতে লাশের কতখানি ফুলতে হয়েছিল, অর্থাৎ ছেলেটির ভাসবার ক্ষমতা কতখানি হয়েছিল। নদীর কারেন্ট ঘন্টায় কয় মাইল, ষ্টীমারে জেনে নিয়েছিলাম। খুব সহজেই বেরিয়ে পড়লো গোয়ালন্দের কতখানি উজানে লাশ জলে ফেলা হয়েছিল। একটু অঙ্ক জানলেই তা বের করা যায়। তারপর হাসপাতাল থেকে গোয়ালন্দ স্টীমার ঘাটে ফোন করে জানলাম সেখান থেকে উত্তরে নদীপথে বিশ থেকে ষাট মাইলের মধ্যে কেবল একটাই শহর আছে। সেটা কুষ্টিয়া। অতএব আমি সোজা কুষ্টিয়ার টিকিট কাটলাম।
আমি হাসপাতাল থেকে ক্টেশনে যাবার পথেই ভেবে নিয়েছিলাম। খুনী নিশ্চয়ই নদীর পারে থাকে। তার কারণ সেখান থেকে লাশ নদীতে ভাসানোর সুবিধা। তাছাড়া আমি জানতাম হয় খুনীর একটা লঞ্চ আছে, নয় সে আর কারও লঞ্চ ব্যবহার করে। কারণ মানুষ চুরির তিনদিন পর খবরের কাগজে গোয়ালন্দে লাশ প্রাপ্তির খবর বেরোয়। ঢাকা থেকে রাতের বেলা মানুষ চুরি যায়; রাতে স্টীমার নেই। বেলা দুটোর সময় রওনা হয়ে কুষ্টিয়া পৌঁছে বেলা দশটার দিকে; দিনের বেলা লাশ জলে ফেলা সম্ভব না। রাতের বেলা ফেলতে হয়। তারপর ধরো ছসাত ঘণ্টা মানুষের উপর experiment করা হলো; লাশ গোয়ালন্দে পৌঁছতে একদিন লাগে। খবরের কাগজে খবর ছাপাতে একদিন লাগে, কারণ কাগজে সবসময় একদিন আগের ঘটনা বেরোয়। সেদিনের ঘটনা বেরোয় না। সুতরাং খেয়াল করে দেখো, দিন অনেক বেশি লেগে যাচ্ছে। তাছাড়া ষ্টীমারে আনতে অনেক অসুবিধাও আছে। অতএব সে একটা লঞ্চে করে এসে মানুষ আর টাকা পয়সা চুরি করে সেই রাতেই রওনা হয়ে যায় কুষ্টিয়ার দিকে তা স্পষ্টই বোঝা যায়। লঞ্চে ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া আসতে দশ বারো ঘন্টার বেশি লাগে না।
আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত ছিলাম-কুয়াশাকে আমি খুজে বের করতে পারবই। মফঃস্বল টাউনে শতো শতো লঞ্চের মালিক থাকতে পারে না। তাই আমি নদীর পাড়ের আদর্শ হিন্দ হোটেলে হিন্দু সেজে উঠলাম। আমি কেবল চাইছিলাম, আমাকে যেন কুয়াশা খুজে বের করতে না পারে। তাই আমি তোকে নির্দেশ দিয়েছিলাম গফুরকে আমার মতো করে সাজিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে। আমি জানতাম তোরা একটু সাবধান হলেই কুয়াশার স্পাই বুঝতে পারবে না গফুরের ছদ্মবেশ। কারণ ও লোকটা সত্যিই ছিলো কিছু বোকা; আমি ওকে গোয়ালন্দে যে কোনো মুহুর্তে ধরতে পারতাম। তোরাও খুব সুন্দর অভিনয় করেছিলি। আমি এদিক দিয়ে নিরাপদ রইলাম।
আমাকে কিন্তু বেশি ঘোরাঘুরি করতে হয়নি। রফিকুল ইসলামের সাথে পরিচয় হয়ে গেল বাজনার ব্যাপার নিয়ে। তার একটা লঞ্চ আছে শুনে চমকে উঠলাম। কেমন সন্দেহ হলো।
একদিন নদীর পারে বসে অনেক তত্ত্বালোচনা হচ্ছিলো। আমি হঠাৎ তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, কুয়াশা। তার মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল। আমার যা দেখবার দেখে নিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে গলায় অত্যন্ত ভাব এনে বললাম, কুয়াশায় আমার চারিটা পাশ ঘন হয়ে আসছে, রকিক সাহেব। আমি যেন মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পাই। যতো বয়স বাড়ছে ততোই আচ্ছন্ন হয়ে আসছি। বড় ভয় করে মাঝে মাঝে।
কুয়াশা ততোক্ষণে সামলে নিয়েছে, কিন্তু সেদিন আর বেশি জমলো না। আমি হোটেলে ফিরে এসে কুয়াশার চিঠি বের করলাম; তারপর আগের দিন রফিক সাহেব আমাকে কতগুলো ঠিকানা লিখে দিয়েছিল একটা নোট বইতে, সেটা বের করলাম। মিলিয়ে দেখলাম সম্পূর্ণ এক। আগে আমি লক্ষ্যই করিনি রকিক সাহেবের লেখা।
তার পরদিন gastric pain-এর অজুহাতে রাতে আর তার বাসায় যাবো না বলে দিলাম। রফিক সাহেব একমনে সরোদ বাজাচ্ছে, তখন আমি চুপি চুপি তার বাসায় ঢুকলাম। আমি বাড়ির সবকিছুই চিনতাম। সোজা দোতলায় উঠে যে অংশট বন্ধ ছিলো তার তালায় একগোছা চাবি try করা শুরু করলাম। একটা চাবি লেগে গেল ভাগ্যক্রমে। আমার কোনও সন্দেহ নেই তখন, রফিকুল ইসলামই কুয়াশা। কিন্তু প্রমাণ কই? কোনও প্রমাণ ছিলো না আমার হাতে। যে সব যন্ত্রপাতি সেই ঘরে ছিলো তাতে কিছুই প্রমাণ করা যার না। একটা দেরাজের মধ্যে অনেকগুলো টেলিগ্রাম পেলাম। সবগুলোতে লেখা THEY ARE HERE. সব কটা গোয়ালন্দ থেকে করা। দেরাজের মধ্যে ডায়রী পেলাম একটা। হাতে যেন স্বর্গ পেলাম। তার থেকেই জানতে পারি কুয়াশার পরবর্তী শিকার কে।
আর দিনক্ষণ বুঝতে পারি গতকাল। সন্ধ্যায় টেলিগ্রামটা কিছুক্ষণের জন্যে ফেলে গেছিলো রফিকুল ইসলাম আমার ঘরে টেবিলের উপর। আমি চুরি করে সেটা পড়লাম। তাতে লেখা THEY ARE LOST.
আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। কুয়াশার লোক গফুর আর তোর ওপর কড়া নজর রেখেছিল। সে গফুরের ছদ্মবেশ ধরতে না পেরে, মনে করেছিল আমি আর তুই গোয়ালন্দে আছি। বেচারার চোখকে ফাকি দিয়ে যখন তোরা চলে এলি তখন সে মনিবের কাছে টেলিগ্রাম করলো THEY ARE LOST.
আমি বুঝলাম, নিশ্চয় কুয়াশা চিন্তায় পড়ে গেছে। সে শহীদ খানকে ভয় করতো দস্তুর মতো। সে যতো তাড়াতাড়ি কাজ সারা যায় তারই চেষ্টা করবে। আর তাই হয়েছিল দেখতে পেয়েছিস।