ফোঁস করে একটা দীর্ষনিঃশ্বাস ফেললো শহীদ। দারোগা সাহেব এসে ঢুকলেন ঘরে। বললেন, ব্যাটাকে হাতড়া পরিয়ে দুজন পুলিশ দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম হাজতে। এখন ঘোড়াগাড়ির জন্যে লোক পাঠিয়েছি। গাড়ি এলে হেকমত সাহেবকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে তবে আমার ছুটি।
আমরাও যাবে। আপনার সাথে। পথে একজন ভালো ডাক্তারকে তুলে নিয়ে যেতে হবে।
১৪.
হেকমত আলীর বাসা। রাত প্রায় এগারোটা। হেকমত আলীকে কিছুক্ষণ হলো নিয়ে এসেছে শহীদরা। তার ঘরে ডাক্তার বসে রয়েছেন। কামাল, শহীদ, আর দারোগা সাহেব বৈঠকখানায় বসে আছে। ঘরটায় আসবাবপত্র একেবারেই নেই। শুধু একটা কাঠের খটখটে চারকোণা টেবিল আর তার চারধারে কতগুলো চেয়ার।
আপনি চললেন, দারোগা সাহেব? শহীদ জিজ্ঞেস করলো।
না। ডাক্তার যখন বলছে অবস্থা খারাপ, তখন দেখেই যাই কি হয়। সারাদিন ধকল গেছে- আর একটু না হয় সহ্য করি।
মহুয়া এসে দাঁড়ালো। সে একবার বাবার পাশে যাচ্ছে। আবার বৈঠকখানায় এসে দাঁড়াচ্ছে। সে বললো, আপনারা কেউ এখন যাবেন না কিন্তু, পানি চড়িয়ে দিয়েছি, চা খেয়ে তারপর যাবেন।
তুমি এতো রাতে আবার কষ্ট করতে হলে কেন মহুয়া। শহীদ বলে।
আপনারা কতো বিপদ মাথায় নিয়ে, কতো কষ্ট করে বাবাকে উদ্ধার করে আনলেন, আর আমাকে সামান্য চা করবার কষ্টও সহ্য করতে দেবেন না? মিষ্টি গলায় বলে মহুয়া।
এমন সময় একজন বেঁটে, গাঁট্টা-গোট্টা লোক এসে ঢুকলো ঘরে। পরনে কালো স্যুট, মাথায় ফেস্ট হ্যাট, হাতে একটা বর্মা চুরুট। ঘরে ঢুকেই সে বললো, আমার জন্যেও এক কাপ, মিস মহুয়া।
সবাই তার দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকালো। সে হঠাৎ মাথার টুপি খুলে মাথাটা সামনে বুকালো। মুহুর্তে শহীদ, কামাল আর মহুয়া তাকে চিনতে পারলো। তার মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। কালকের সেই লোকটা।
বসুন, মি. জাকারিয়া। শহীদ সহাস্যে বলে। জাকারিয়াও একটু হেসে একটা চেয়ারে বসে পড়লো
আমি আপনাদের খোঁজে হোটেলে গিয়েছিলাম। আপনার চাকর বললো আপনারা এ বাড়িতে। তাই সটান চলে এলাম। আমার কতকগুলো প্রশ্ন আছে, সেগুলোর উত্তর আপনার কাছ থেকে জেনে না নিলে কিছুতেই শান্তি হচ্ছে না।
এমন সময় পাশের ঘর থেকে চিৎকার শোনা গেল, মেরে ফেলে, পায়ে পড়ি, আমায় মেরে ফেলো।…
চমকে উঠে জাকারিয়া জিজ্ঞেস করে, কে, কে চিৎকার করে?
দারোগা সাহেব তার কানে কানে বললো, হেকমত আলী পাগল হয়ে গেছেন, বোধহয় বাঁচবেন না।
কেন? হঠাৎ? কি ব্যাপার?
দারোগা সাহেব সংক্ষেপে বললো ওকে সেদিনকার সব ঘটনা। শহীদ সব শেষে বললো হেকমত আলীর পাগল হওয়ার কথা।
So sad চুরুটে টান দেয় জাকারিয়া। তাহলে আসল culprit পালিয়েছে। আপনিও পেলেন না শহীদ সাহেব, আমিও পেলাম না, মুচকে হাসে সে।
আচ্ছা, মিঃ জাকারিয়া, আপনি কেন মিছিমিছি আমার পেছনে লেগেছিলেন বলুন তো?
আমি রাজবাড়ীর সরকারী গোয়েন্দা। এই কেসটার investigation আমিই করছিলাম।
বাঁধা দিয়ে শহীদ বললো, সে সব জানি। আপনি বলুন পৃথিবীতে এতো মন্দ লোক থাকতে আমাকে আপনার সন্দেহ হলো কেন?
চুরুটে সুদীর্ঘ একটা টান দিয়ে জাকারিয়া বললোগোয়ালন্দ থেকে একটা বাচ্চার লাশ এলো রাজবাড়ীতে। কিন্তু পাহারাদার পুলিসের একজন চুপিচুপি একটা বাক্স স্টেশন মাস্টারের ঘরে রেখে এলো তা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। তারপর দেখলাম, হাসপাতালের ডাক্তারের সাথে সে পুলিসের কি গল্প। একবার লাশটা ওজন করে, একবার পাথরটা ওজন করে! খুব সন্দেহ হলো আমার। পরে যখন পুলিসটা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে স্টেশনের দিকে হাটা শুরু করলো তখন আমি ডাক্তারের কাছে গিয়ে পুলিসটার পরিচয় জানবার দাবি করলাম। তিনি সোজা আমাকে খেদিয়ে দিলেন। বললেন যে তিনি চেনেন না পুলিসটাকে, তার সাথে একটা কথাও বলেননি তিনি। আমি বেশি বাড়াবাড়ি করলে পুলিসে ফোন করবেন।
অগত্যা আমি স্টেশনে গেলাম। দেখি বাক্সটা নিয়ে আপার ক্লাস ওয়েটিং রুমে ঢুকলো পুলিসটা। কিছুক্ষণ পর দেখি একজন প্রৌঢ় হিন্দু ভদ্রলোক বেরিয়ে এলো ওয়েটিং রুম থেকে। তারপর কুলি ডেকে সেই বাক্সটা গাড়িতে ওঠালো। আমি চট করে ওয়েটিং রুমের ভেতরটা এক চক্কর দেখে এলাম, কোনও পুলিসের পাত্তা নেই। অতএব সন্দেহ দৃঢ়তর হলো। বুঝলাম হয় এই ব্যাটাই খুনী নয় খুনীর নিযুক্ত কর্মচারী। ডাক্তারের সঙ্গে এদের সায় আছে।
বাস পিছন ধরলাম। তারপর কুষ্টিয়ায় এসে সন্দেহ উত্তরোত্তর বেড়েই চললো। প্রমাণের অভাবে ধরতে পারছি না। একদিন হোটেলে হানা দিয়ে পরচুলা, পেইন্ট সব দেখে এলাম। বুঝতে পারছেন না, আমি over sure. এই ব্যাটা খুনী না হয়ে যায় না।
খুব একচোট হাসলো জাকারিয়া। তারপর নিভে যাওয়া চুরুটটা ধরিয়ে নিলো।
মহুয়া চা নিয়ে এলো। চায়ে এক চুমুক দিয়ে কামাল শহীদকে বললো, আমার কিন্তু কতকগুলো ব্যাপারে খটকা আছে। এখন একটু পরিষ্কার করে দে তো ভাই। তুই জানলি কি করে কুষ্টিয়াতেই কুয়াশা রয়েছেঃ রফিক সাহেবকে তোর সন্দেহ হলো কি করে? এই বাড়িতে কাল কুয়াশা আসবে কি করে বুঝলি?
মহুয়া গুনবার জন্যে একটা চেয়ারে বসে পড়লো। শহীদ একটা সিগারেট ধরালো, দারোগা সাহেবের দিকে প্যাকেট বাড়ালো। তিনি খান না। কামাল একটা তুলে নিলো।