আরও আগে থেকে বলি, নইলে ভালো করে বুঝতে পারবে না।
আমার academic qualification-এর কথা শুনলে আশ্চর্য হবে। আমি ম্যাট্রিক পাস। ছোটকাল থেকেই আমার সঙ্গীতের প্রতি ঝোঁক ছিলো। একটা সারোদ কিনেছিলাম। বাবাই কিনে দিয়েছিলেন। পড়াশোনাতে আমি খুবই ভালো ছিলাম।
কিন্তু ম্যাটিক পাস করবার পর আমি সরোদ নিয়েই অতিরিক্ত মেতে উঠি। ফলে। I..S.C.-তে ফেল করলাম। বাবা খুবই আঘাত পেয়েছিলেন, কিন্তু কিছুই বলেননি আমায়। আমি তখন অন্য ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত। একটা তারে টোকা দিলে একটা সুর বাজে, তারপর আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। আমার চিন্তা হলো, মিলিয়ে যায় কোথায়? জানতাম সেকেন্ডে কতবার থেকে কতবার কাঁপলে তারের শব্দ মানুষ শুনতে পায়। কিন্তু তার বেশি বা কম যদি কাপে? তাহলে? শোনা না গেলেও তো সে কাঁপন বাতাসে থেকে যায়। জানবার খুব আগ্ৰহ হলো। ঠিক এই সময়ে একটা বই পেয়ে গেলাম আলট্রা সোনিক্স সম্বন্ধে। সেটা পড়ে আগ্রহ আরও বাড়লো। আরও কতগুলো কিনলাম। এদিকে বাবা ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠছেন। শেষে যখন পড়াশোনা একেবারে ছেড়ে দিয়ে আলাট্রা সোনিক্সের experiment শুরু করলাম, তখন একদিন ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দেন বাবা। আমি বাবার দোষ দিই না। তিনি অনেক সহ্য করেছিলেন।
আমি কলকাতায় চলে গেলাম। খেয়ে না খেয়ে দুবছর সেখানে কাটালাম। কাল ব্যান্ডে নবার্গ নামে একজন জার্মান বৈজ্ঞানিক তখন কলকাতায় এসেছিলেন। ইউনিভারসিটির আমন্ত্রণে। আমি সোজা তার কাছে গিয়ে বললাম, আপনি বৈজ্ঞানিক, আপনি আমার ব্যকুলতা বুঝবেন, আপনি আমাকে সাহায্য করুন। আমি তাকে impress করতে পেরেছিলাম। তিনি আমাকে জার্মানীতে নিয়ে গেলেন সাথে করে। সেখানে পনেরো বছর কাটিয়েছি আমি।
সতেরো আঠারো বছর বয়সে আমি বাঙলা ছেড়েছিলাম। এই কুষ্টিয়ায় আমার বাড়ি। ছোট দুবছরের বোনটিকে খুব মনে পড়তো। ওকে দেখবার জন্য সুদূর জার্মানীতে বসে অনেক ছটফট করেছি। কতো বিনিদ্র রাত আমার কেটেছে মায়ের জন্যে বুক ভাসিয়ে কেঁদে।
যখন দেশে ফিরে এলাম তথন সকলের আগে ছুটে এলাম কুষ্টিয়ায়। মা অনেকদিন হলো মারা গেছেন। বাবা যক্ষ্মা হয়ে বিছানা ধরেছেন। ছোটো বোনটা কতবড় হয়েছে। সে ম্যাটিক পাস করে তখন মাষ্টারি করছে স্কুলে, আর সেই সঙ্গে কলেজেও ভর্তি হয়েছে। তুমি ঠিকই সন্দেহ করছো শহীদ, হেকমত আলী সাহেবই আমার বাবা, মহুয়া আমার ছোটো বোন। আমিই শখ করে তার নাম রেখেছিলাম মহুয়া। আমার নাম মনসুর আলী।
আমি নিজের পরিচয় দিলাম না। ঢাকায় গিয়ে আমি আমার গবেষণার জন্যে সরকারের সাহায্য চাইলাম। আমার কোনও qualification নেই। কেউ আমার কথা কানেই তুললো না। অনেক তদবির করলাম, ইউনিভারসিটিতে চেষ্টা করলাম, কোথাও কিছু হলো না। কয়েকজন ধনী লোকের কাছে গেলাম। তারা হাঁকিয়ে দিলো। তখন আমি কপর্দকশূন্য। সেই সময়ই আমি প্রথম ডাকাতি করি। তোমার হয়তো খেয়াল থাকতে পারে, আজ থেকে তিন বৎসর আগে ব্যাঙ্ক থেকে কয়েক হাজার টাকা চুরি গিয়েছিল। কি ভাবে চুরি হলো তা অনেক চেষ্টা করেও পুলিসের Intelligence Branch ধরতে পারেনি। সে টাকা আমিই চুরি করি। তারপর সে টাকা দিয়ে এখানে established হই ভেবেছিলাম ধীরে ধীরে ব্যবসায় উন্নতি করে টাকা পয়সা করে। নিজের গবেষণা চালিয়ে যাবো। কিন্তু তা আর হলো না। অনেক চেষ্টা করেও আমি মহুয়াকে অর্থ সাহায্য করতে পারিনি। বড় একরোখা মেয়ে। এদিকে চিকিৎসার অভাবে বাবার শরীর একেবারে ভেঙে পড়েছে। আমি দেরি করলে হয়তো তিনি আর বাঁচবেন না। তাই আমাকে যতো শিগগির সব টাকা জোগাড় করতে হয়, experiment করবার জন্যে মানুষ খুন করতে হয়।
আজ আমার সামনে একটা খাটের উপর শুয়ে আছেন আমার বাবা। আর কিছুক্ষণ পর তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন। তারপর আমি চলে যাবো অনেক দূরে। কোনদিন বাবার কাছে নিজের পরিচয় দেবো না-তার যে ছেলেকে তিনি ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন একদিন, সে মরে গেছে, কোনও দিন আর ফিরে আসবে না। আমার বুঝি অভিমান নেই?
কিন্তু বলিহারী তোমার বুদ্ধিকে। তোমায় এক ফোঁটাও সন্দেহ করতে পারিনি আমি। অথচ তুমি দিনের পর দিন আমার কার্যকলাপ লক্ষ্য করেছো। এখন মনে পড়ছে, আমি নিঃসন্দেহে তোমাকে কতকগুলো ঠিকানা লিখে দিয়েছি। উহ, কি বোকা আমি। আমি প্রত্যেকদিন টেলিগ্রাম পেয়েছি আমার লোক মারফত গোয়ালন্দ থেকে, they are here.
আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে। যে কদিন তুমি আমাকে তোমার বন্ধুত্ব উপহার দিয়েছিলে তার জন্যে তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমায় বন্ধু বলে স্বীকার করেছি বলেই অনাথ চক্রবর্তী আমার হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। আমি বন্ধুত্বের মর্যাদা রেখেছি। তুমিন না হয়ে যদি আর কেউ হতো, তার কাছে অনেক টাকা পয়সা নিয়ে নায়েব এসেছে জানতে পারলে আমি সে টাকা ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করতে কসুর করতাম না। আমি তোমায় চিরকাল বন্ধু বলেই জানবো। আমার পেছনে অনেক ঘুরেও শেষ পর্যন্ত আমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না তুমি।
বিদায় বন্ধু! আর হয়তো তোমার সাথে দেখা হবে না কোনও দিন। আমার বাজনাও আর শুনতে পাবে না তুমি। আমার ছন্নছাড়া জীবনে একজনই পেয়েছিলাম, তাকেও বাধ্য হয়ে হারাতে হচ্ছে আজ।