যাওয়ার আগে আমাকে খুন করে যাও! আর পারি না! পায়ে পড়ি তোমার!
দু হাত দিয়ে মুখ ঢাকে কুয়াশা। তারপর ঘুরে দাঁড়ায়।
ঠিক এমনি সময় শহীদ আর কামাল এসে ঢুকলো ঘরে। দুজনের হাতেই উদ্যত রিভলবার।
মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়াও, কুয়াশা।
চমকে উঠলো কুয়াশা। তারপর বিদ্যুৎগতিতে টেবিলের উপর থেকে যন্ত্রটা তুলে নিলো হাতে। সাথে সাথেই গর্জে উঠলো শহীদের রিভলবার। ক্যামেরার চোখের মতো একটা চোখ ছিলো যন্ত্ৰটার। সেই কাঁচের চোখটা গুড়ো করে দিয়ে শহীদের অব্যর্থ বুলেট প্রবেশ করলে৷ যন্ত্রটার মধ্যে। ঝন ঝন করে একটা শব্দ হলো। বিকল হয়ে গেল যন্ত্র।
করলে কি শহীদ। আমার সারা জীবনের সাধনা নষ্ট করে দিলে। বিকৃত হয়ে গেল কুয়াশার মুখ। গভীর বেদনার ছাপ ফুটে উঠলো তাতে। আরো কি যেন বলতে চেষ্টা করলো কুয়াশা; তার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে। কেবল ঠোঁট নড়লো, কথা বেরোলো না।
এমন সময় পিছন থেকে বড় কণ্ঠে আওয়াজ এলো, হ্যান্ডস আপ।
ঘুরে দাঁড়ালো ওরা দুজন। সামনে কেউ নেই। আবার আওয়াজ এলো, হাত থেকে রিভলব্যর ফেলে দাও, নইলে খুলি ফুটো করে দেবো। আমি দরজার আড়ালেই রয়েছি!
দুজনেই ফেলে দিলো রিভলবার।
এবার মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়াও।
শহীদ, কামাল মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়ালো। একমিনিট, দুইমিনিট। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ওরা। কেউ আসে না আর সামনে। কোনো কথাও নেই। ওরা পরস্পরের দিকে ফিরে তাকালো। শহীদ পিছন ফিরে দেখলো কুয়াশা অদৃশ্য হয়ে গেছে পিছন। থেকে। মূহুর্তে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল শহীদের কাছে। মাটি থেকে রিভলবারটা কুড়িয়ে নিয়ে শহীদ ছুটে গেল পাশের ঘরে। সেখানেও নেই কুয়াশা। ঘরের এক কোণে একটা গৰ্ত মতো জায়গা পাওয়া গেল। সিড়ি নেমে গেছে নিচে। একটা চৌকোণা পাথর চাপা ছিলো গর্তের মুখে। পাথরটা এখন সরানো।
নেমে গোল শহীদ সিড়ি বেয়ে। কামালও নামলো পিছন পিছন। ঘন অন্ধকার ভিতরে। নিজের হাত পর্যন্ত দেখা যায় না। সাবধানে যতোটা সম্ভব তাড়াতাড়ি নেমে শহীদ হোঁচট খেলো। সিড়ি শেষ হয়ে গেছে সে টের পায়নি। সামলে নিয়ে চারদিকে হাত বাড়ালো শহীদ। একটা দিক ছাড়া সব দিকই বন্ধ। এগিয়ে গেল শহীদ খোলা পথটা ধরে। পুরো পাঁচ মিনিট চলার পর পথটা শেষ হলো। কয়েক ধাপ সিড়ি দিয়ে উঠে একটা পাথর ঠেকলো হাতে। বেশ ভারি পাথর। প্রাণপণ শক্তিতে ঠেলা দিয়ে পাথরটা সরিয়ে ফেললো শহীদ। লাফিয়ে বেরিয়ে এলো ওরা। খোলা আকাশ, তারা মিটমিট কাছে। সামনে গড়াই নদী। একটা লঞ্চ দাড়িয়ে আছে ঘাট থেকে বেশ অনেকটা দূরে।
হঠাৎ শহীদের খুব কাছে থেকে শব্দ এলো, শহীদ খান, আমার সারা জীবনের সাধনা তুমি নষ্ট করে দিয়েছো। প্রস্তুত থেকো, আমি নির্মম প্রতিশোধ নেবো।
কামাল চারদিকে তাকাচ্ছে, কে কথা বলে? শহীদ বললো, কাকে খুজছিস কামাল। কুয়াশা এখন লঞ্চের মধ্যে।
বলতে না বলতেই মৃদু গর্জন করে লঞ্চ ষ্টার্চ দিলো। চলতে আরম্ভ করেছে লঞ্চটা। কামাল রিভলবার ছুঁড়লো লঞ্চ লক্ষ্য করে। দূর থেকে একটা অট্টহাসি শোনা গেল। অনেকক্ষণ ধরে সে হাসি নদীর পারের বাড়িগুলোতে প্রতিধ্বনি তুললো। শহীদ একটা দীর্থ নিঃশ্বাস ফেললো। পাশ থেকে কে বলে উঠলো, পালিয়ে গেল, না?
শহীদ চেয়ে দেখলো দারোগা সাহেব কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
আবার তারা তিনজন সুড়ঙ্গ দিয়ে ফিরে এলো কুয়াশার পরিত্যক্ত বাড়িতে। হেকমত আলী তেমনি শুয়ে আছেন। কিছুক্ষণ নির্জীব হয়ে পড়ে থাকেন, তারপর হঠাৎ চমকে ওঠেন আতঙ্কিত হয়ে। চিৎকার করে ওঠেন, মেরে ফেলো! পায়ে পড়ি, মেরে ফেলো!
ঘরের মধ্যে কুয়াশার যন্ত্রটা পড়ে আছে। আরও কয়েকটা অদ্ভুত আকারের যন্ত্র টেবিলের উপর রাখা। টেবিলের উপর একটা প্যাডের দিকে শহীদের নজর গেল। একটা চিঠি লেখা রয়েছে। সম্বোধনটা পড়ে আশ্চর্য হোলো শহীদ, তাকেই লেখা। দারোগা সাহেবের দিকে তাকিয়ে শহীদ বললো, তিনতলার উপর একজন লোক হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। তাকে হাজতে পাঠিয়ে দিন। আর হেকমত আলী সাহেবকে তার বাড়িতে পৌছাবার একটা ব্যবস্থা করে দিন।
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে চিঠিটা পড়তে শুরু করে শহীদঃ
শহীদ খান,
তুমি যখন এ ঘরে উপস্থিত হবে তখন আমি বহুদূরে। আজ আমার শেষ পরীক্ষা। যদি সফল হই, পৃথিবী আমায় পুজো করবে। আর যদি সফল হতে না পারি, চিরকালের জন্যে আমার প্রতিভার পরিসমাপ্তি ঘটবে। সে ক্ষেত্রেও আমায় চলে যেতে হবে এখান থেকে। কারণ, তুমি আমায় চিনে ফেলেছো।
তোমায় আমি বন্ধু হিসেবে নিয়েছিলাম-সত্যিই তুমি তার যোগ্য। পৃথিবীতে কেউ যদি আমায় বুঝে থাকে, সে হচ্ছো তুমি। কার্ল ব্র্যান্ডে নবাৰ্গও আমাকে বোঝেননি। আমি তারই হাতে মানুষ, তিনিই আমাকে সবরকম শিক্ষা দীক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু যেদিন তিনি আমায় জোর করে জার্মানীতে আটকে রেখে আমার গবেষণার ফল ভোগ করতে চেষ্টা করেছিলেন, সেদিন তাকে নির্মমভাবে হত্যা করতে আমার কিছুমাত্র বাধেনি। আমি বাঙালী। আমি বাঙলা থেকে আমার পরীক্ষার ফল পৃথিবীকে জানাবো। জার্মানী থেকে পালিয়ে আসতে হয় আমাকে পুলিসের ভয়ে। কিন্তু এ দেশে এসে কি পেলাম? পুলিসের তাড়া। কিন্তু তোমার কাছ থেকেও কি আমি সহানুভূতি আশা করতে পারি না? পারি না একটু মায়া, একটু ভালবাসার দাবি করতে?