আমার গুলি কোনদিন মিস হয় না। দারোগা রিভলবার তুললেন।
আহ! পাগলামি করবেন না, দারোগ৷ সাহেব। আরও যন্ত্র এবং আরও লোক নেই তা কে বললো আপনাকে আপনার দোষে কুয়াশাকে তো হারাবই, প্ৰাণটাও যাবে। আমার কথা শুনুন। যতক্ষণ না বাড়ির ভেতর ঢুকবার চেষ্টা করছি আমরা ততক্ষণ কেউ কিছু বলবে না। আমরা কেউ তো ইউনিফর্ম পরে নেই। আমি আর কামাল বাড়িটার পেছন দিকে চলে যাই। আপনারা সামনে দিয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকুন। লোকটার দৃষ্টি যখন আপনাদের দিকে যাবে তখন ও সেদিকেই নজর রাখবে বেশি। আমর৷ সেই সুযোগে পেছন দিয়ে ভেতরে ঢুকবো।
দুদলে ভাগ হয়ে গেল তারা। শহীদ আর কামাল অনেকটা ঘুরে জঙ্গল আর আবর্জনা পেরিয়ে বাড়িটার পিছনে গিয়ে উপস্থিত হলো। পাঁচিলটা বেশ উচু। একজনের পক্ষে খালি হাতে বেয়ে ওঠা অসম্ভব। কামালের কাঁধে পা দিয়ে দাড়িয়ে দেয়ালের উপরটা ধরলো শহীদ, তারপর এক হাত দিয়ে কামালকে টেনে তুললো। দু জনে হাত দিয়ে দেয়াল ধরে ঝুলে রয়েছে। মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে দেখে শহীদ লোকটা ঘুরেই চলছে অনবরত। এক জায়গায় গিয়ে সে অদৃশ্য হয়ে যায়, আবার আধ মিনিট পর সম্পূর্ণ ছাতটা ঘুরে আসে। কিন্তু এই আধ মিনিটের মধ্যে দেয়াল টপকে দৌড়ে গিয়ে বাড়ির গা ঘেষে দাঁড়ানো অসম্ভব-মাঝের জায়গাটা বেশ বড়, ধরা পড়ে যাবে।
হাতটা ব্যথা হয়ে আসে কামালের। এবার আধ মিনিট পার হয়ে গেল, লোকটা আসছে না। প্রায় মিনিট দুয়েক পর এসে ঘুরে গেল। অমনি শহীদ দেয়াল টপকে ওপাশে লাফিয়ে পড়লো। কামালও এলো। শহীদ বললো, আমার পেছন পেছন দৌড় দে। প্ৰাণপণে ছুটলো দুজন বাড়িটার দিকে। বেশ বড় কম্পাউন্ড। মাঠ পার হয়ে বাড়িটার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো ওরা। ফিসফিস করে শহীদ বললো, বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। ব্যাটা এখন পুলিসদের ওপর খুব কড়া নজর রাখছে।
বাড়িটার মধ্যে কোনও প্রাণের সাড়া পাওয়া গেল না। অতি সন্তৰ্পণে নিঝুম বাড়ির ছাতের সিড়ির কাছে এসে দাড়ালো ওরা। সিড়িটা অন্ধকার পা টিপে টিপে শহীদ আর কামাল উঠে এলো সিড়ি বেয়ে। লোকটাকে দেখা গেল। ব্যস্ত পদে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছাতের উপর বাক্স হাতে। বাড়ির সামনের দিকটায় তার নজর বেশি। সামনের দিকে ঝুঁকে মাঝে মাঝে কি যেন ভালো করে লক্ষ্য করে দেখছে ও। এই যে, চারদিকটা একবার ঘুরে এসে আবার ঝুঁকলো লোকটা। কামালের গা টিপে তাকে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে ইশারা করে শহীদ বাঘের মতো দ্রুত অথচ নিঃশব্দ গতিতে এগিয়ে গেল তার দিকে। লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যেই ঘুরেছে অমনি প্রচও এক মুষ্টাঘাত এসে পড়লো তার নাকের উপর। চারদিকে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলো লোকটা। এবার একটু পিছিয়ে এসে স্টেপ নিয়ে একটা পুরো নক-আউট পাঞ্চ কাষালো শহীদ। ঘুরে পড়ে গেল লোকটা। ঠক করে যন্ত্রটা তার হাত থেকে ছিটকে নিচে পড়লো।
কামাল এসে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। একটা রুমাল লোকটার মুখের মধ্যে গুঁজে দিয়ে সিল্কের দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেললো তাকে কামাল। লোকটাকে সেইখানেই ফেলে রেখে কামাল আর শহীদ সাবধানে সিড়ি বেয়ে নেমে এলো আবার।
দশটা বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। কুয়াশা কলম বন্ধ করে ঘড়ির দিকে চাইলো। হেকমত আলীর পাশে এসে দাঁড়ালো সে। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে তার গবেষণার ফল জানতে পারা যাবে। দীর্ঘ পনেরো বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম। হয় আজ সাফল্য, নয় পরাজয়।
ঠিক দশটার সময়ে যন্ত্রটা বন্ধ করে দিলো সে। অল্প অল্প করে বেশ খানিকটা ব্রান্ডি খাওয়ালো হেকমত আলীকে। তারপর বাঁধন খুলে দিলো তার। খুব সাবধানে উঠিয়ে বসালো তাকে। বললো, একটু কেশে খানিকটা কফ বের করুন তো হেকমত সাহেব। হ্যাঁ, এই কাচটার ওপর ফেলুন। এবার শুয়ে পড়ুন।
মাইক্রোস্কোপের কাছে সরে এলো কুয়াশা। তার মুখ অত্যন্ত গম্ভীর। হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠলো, ইউরেকা, ইউরেকা! Successful!
আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো কুয়াশার মুখ। হেকমত আলীর দিকে ফিরে বললো, আপনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ হেকমত সাহেব। এখনও আপনার লাংসে কিছু ক্ষত আছে, তবে সেটা সেরে যেতে পনেরো দিনের বেশি লাগবে না। আপনি বাড়ি ফিরে আপনার সব পুরনো জামা কাপড় পুড়িয়ে ফেলবেন। নইলে আবার ধরবার সম্ভাবনা আছে। একটু ভালো diet খেলে তিনমাসের মধ্যে আপনি আপনার আগের স্বাস্থ্য ফিরে পাবেন। আপনার শরীরে এখন একটিও জীবিত যক্ষ্মা বীজাণু নেই, হেকমত সাহেব।
ফ্যালফ্যাল করে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন হেকমত সাহেব। তারপর হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, মেরে ফেলো আমাকে। আর কষ্ট দিও না! মেরে ফেলো, তোমার পায়ে পড়ি মেরে ফেলে!
চমকে ফিরে তাকায় কুয়াশা। হেকমত আলীর চোখ দুটো রক্ত জবার মতো লাল টকটকে। পাগল হয়ে গিয়েছেন হেকমত আলী। চিৎকার করে বললেন, পানি, পানি দাও।
কয়েক চামচ ব্রান্ডি ঢেলে দিলো কুয়াশা তাঁর গলায়।
মেরে, কোলো। উঃ! তোমার পায়ে পড়ি মেরে ফেলো। আবার চিৎকার।
ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে কুয়াশা। টেবিলের উপর কনুই রেখে কপালের দু ধার টিপে ধরে সে। আর অপেক্ষা করা চলে না। শহীদ খান এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়িতে ঢুকবার চেষ্টায় ক্ষ্যাপা কুকুর হয়ে গেছে। এক্ষুণি এখান থেকে সরে পড়তে হবে।
উঠে দাঁড়ালো কুয়াশা। কিন্তু একর, এতো বড় পাষন্ড, তার চোখে জল। হেকমত সাহেবের দিকে ফিরে কুয়াশা বললো, আমি চললাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে। আমি নিজ হাতে আপনার এই দশা করলাম। উঃ! তার গলা ভেঙে আসে।