হেকমত আলীর মাথাটা বিমঝিম করছে। ঠিকমত কিছুই চিন্তা করতে পারছেন না। বললেন, বুঝেছি, আপনি বৈজ্ঞানিক। আমিও সাইন্স পড়েছি। আমি বিজ্ঞানের মর্যাদা বুঝি। আপনার গবেষণার ফলে আমার যদি প্ৰাণ যায় তবু আপনার বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিযোগ থাকবে না।
এই তো চাই, হেকমত সাহেব।
বলা তো যায় না-আমি হয়তো যে কোনো মুহুর্তে মারা যেতে পারি। আপনি নিরাপদ হবার জন্যে আমার স্বীকারোক্তি লিখে নেন।
তার দরকার হবে না। প্রথম কথা, আপনি মারা যাবেন না। দ্বিতীয় কথা, যদি আপনি মারাও যান, কাল গোয়ালন্দে নদীর মধ্যে আপনার লাশ পাওয়া যাবে। এ রকম আরও বহু লোককে আমি খুন করেছি। আমারই নাম কুয়াশা।
কালো লোকটাকে কুয়াশা বললো, তুমি এখানে থাকো। উনি পানি খেতে চাইলে দিও। এখন বেলা বাজে চারটা, আমি সাড়ে নয়টায় আসবো আবার। তার মধ্যে কিছু ঘটলে তক্ষুণি আমাকে জানাবে।
একটা বোতল টেবিলের উপর থেকে তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছিলো কুয়াশা, হেকমত আলী বাধা দিলেন। বললেন, আপনার পরীক্ষা শেষ হবে ছ ঘন্টা পর, তার মধ্যেই আপনি পুলিসের হাতে ধরা পড়ে যাবেন।
পুলিসের নামে চমকিত হলো কুয়াশা। বললো, পুলিস?
আপনি জানেন না, আপনাকে ধরবার জন্যে ঢাকার প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান কুষ্টিয়ায় এসেছেন।
আশ্চর্য হয়ে গেল কুয়াশা। সামলে নিয়ে বললো, আপনি জানলেন কি করে?
সে তো আমাদের বাসায় গিয়েছিল। সে-ই তো আমার মেয়ের কাছে একটা বন্দুক রেখে গেছিলো। আমাদের তো বন্দুক নেই। তার বন্দুক দিয়েই কাল রাতে প্রথমবার আপনাকে তাড়ানো হয়েছিল।
আচ্ছা, বন্দুকের রহস্য তবে এই! ভেবেই পাচ্ছিলাম না আপনাদের কাছে বন্দুক.এলো কি করে। তাহলে আপনি বলতে চান শহীদ খান আমাকে চেনে? সে জানলো কি করে যে কাল আপনার বাড়িতে হানা দেবো? ব্যাপারটা ঘোরালো ঠেকছে। তবে কি ধরা পড়ে গেলাম! স্বগতোক্তির মতো বলে কুয়াশা।
সে এখনো আদর্শ হিন্দু হোটেলে অনাথ চক্রবর্তী নাম নিয়ে রয়েছে।
এ্যাঁ! কি বললেন? অনাথ চক্রবর্তী চমকে উঠলো কুয়াশা। কপালে অনেকগুলো কুঞ্চন রেখা পড়লো।
হেকমত আলীর চিন্তা ক্রমেই আড়ষ্ট হয়ে আসছে। কি বলছেন নিজেই বুঝতে পারছেন না ভালো করে। একবার তাঁর মনে হলো, যা বলছেন হয়তো ঠিক হচ্ছে না বলা। আবার ভাবছেন, বলেই ফেলি, কি আর হবে। তার মুখের দিকে চেয়ে কুয়াশা এগিয়ে এলো। আপনার কষ্ট হচ্ছে? মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে কেন?
কি জানি। কেমন যেন লাগছে। কিছুই ভাবতে পারছি না। একটু পানি!
লোকটাকে ইশারা করতেই সে এক গ্লাস পানি আনতে গেল। যন্ত্রটা বন্ধ করে দিলো কুয়াশা। পানি খেয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে চিৎকার করে উঠলেন হেকমত আলী, ছেড়ে দাও আমাকে। আর কষ্ট দিয়ো না।
কুয়াশা মুচকে হাসলো, তারপর যন্ত্রটা আবার চালু করে দিলো।
আপনি পালিয়ে যান বৈজ্ঞানিক। শহীদ খান আপনাকে ধরবে।
সে চেনে আমাকে? আমিই যে কুয়াশা তা সে জানে?
হ্যাঁ, বলেছিল তো চেনে, কেবল প্রমাণের অভাবে ধরতে পারছে না। শান্ত গলা হেকমত আলীর।
তার সাধ্য নেই এইখানে আসবার। কালু তুই এই যন্ত্রটা নিয়ে ছাতে চলে যা। কেউ বাড়ির ভেতর ঢুতে চেষ্টা করলেই এই বোতাম টিপবি। আজ দরকার হলে আমি হাজার হাজার মানুষ খুন করবে, তবু আমার গবেষণা রেখে পালিয়ে যাবো না।
হেকমত সাহেব ঝিমিয়ে এসেছেন। তাঁকে দিয়ে এখন যা খুশি বলিয়ে নেয়া যায়। কুয়াশা হাসে। ভাবে, আর কিছু না হোক, এ যন্ত্র দিয়ে আসামীর স্বীকারোক্তি বের করা যাবে। পৃথিবীকে সে কতো বড় একটা জিনিস দান করছে, অথচ পৃথিবীর মানুষই তাকে বাঁধা দেয়ার জন্যে কেমন আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
শহীদের সাথে আর কে আছে, হেকমত সাহেব? কুয়াশা জিজ্ঞেস করে।
তার বন্ধু কামাল আহমেদ। সে অবিনাশ সেরেস্তাদার নাম নিয়ে ওর সাথে আছে।
কুয়াশা বুঝলো হেকমত আলী ভুল বকছেন না। প্রকৃতিস্থ তিনি সত্যিই নেই। কিন্তু যা বলছেন তা সত্য। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধেও সত্যি কথা বলছেন তিনি
একটা রাইটিং প্যাড নিয়ে এসে টেবিলে বসে কি সব লিখতে আরম্ভ করলো কুয়াশা। হেমত আলী চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। কয়েক ঢোক মদ খেয়ে নেয় কুয়াশা।
দু ঘন্টা পর চোখ খুলে পানি চাইলেন হেকমত আলী। যন্ত্র বন্ধ করে খানিকটা ব্রান্ডি ঢেলে দিলো কুয়াশা তার গলায়।
আমাকে মেরে ফেলো। আর পারি না। আমাকে মেরে ফেলো।
আবার শুরু হলো শব্দ-তরঙ্গ। ঝিমিয়ে এলেন হেকমত আলী। কুয়াশা লিখে চলেছে একমনে। মাঝে মাঝে কলম উঁচু করে অনেকক্ষণ ধরে কি যেন ভাবছে।
১৩.
রাত সাড়ে নয়টা। দোতলা একটা বাড়ির চারদিকে অনেকগুলো একশো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। ছাতের উপর একটা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার হাতে কিসের একটা বাক্স। ছাত্রের কার্নিশ ধরে অনবরত ঘুরে চলেছে লোকটা বাড়িটার চারদিকে দেয়ালের ওপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি রেখে। চারজন কনেষ্টবল, একজন দারোগা, শহীদ আর কামাল এগিয়ে আসছে বাড়িটার দিকে। দূর থেকেই শহীদের নজর গেল ছাতের ওপর। থেমে গেল সে।
ঐ দেখুন, ছাতের ওপর যন্ত্র হাতে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে একজন লোক।
এখান থেকে গুলি করি, বললেন দারোগা সাহেব।
না, ও এখনও টের পায়নি। গুলি মিস করলে এক সেকেন্ডে আল্লার কাছে চলে যাবো আমরা।