আপনি বাবাকে ফিরিয়ে এনে দেন, শহীদ ভাই।
আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। আজ এখানে আমার আসবার কোনও প্রয়োজন ছিলো না, কেবল আপনাকে বলতে এলাম, ভয় পাবেন না, আজই আপনার বাবাকে ফিরিয়ে এনে দেবো। এখন যাই, একটু থানায় যেতে হবে।
আমি আসবো সঙ্গে?
না, দরকার হবে না। পুলিস আসবে না। আপনার এখানে। আপনি নিশ্চিন্ত মনে রান্না করে খাওয়া দাওয়া করুন। বাড়ি ছেড়ে কোথাও বেরোবেন না আজ।
শহীদ আর কামাল বেরিয়ে গেল। শহীদের কপালে চিন্তার রেখা। থানার দিকে এগোলো ওরা।
১২.
ফুটফুটে অন্ধকার ঘরটা। জ্ঞান ফিরে পেলেন হেকমত আলী। কেমন যেন ঘোলা লাগছে সব কিছু। ধীরে ধীরে সব কথা মনে পড়লো তাঁর। একটা খশ খশ শব্দ শুনে জেগে যান তিনি। প্রায় সারারাত জেগে থেকে কাশেন, তাই ঘুম অত্যন্ত পাতলা তাঁর। জেগে গিয়ে তিনি ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কে?
একটা রুমাল দিয়ে তার নাক মুখ চেপে ধরলো যেন কে। একটু ধস্তাধস্তি করেন হেকমত আলী। তাঁর দুর্বল শরীর নির্জীব হয়ে আসে। একটা মিষ্টি গন্ধ, কেমন আবেশ মাখানো। ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে গেল তাঁর। আর কিছুই মনে পড়ছে না।
ঐতো। সেই কালো মূর্তিটারাতে যার সাথে ধস্তাধস্তি করেছেন হেকমত আলী। উঠে বসবার চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু পারলেন না। খাটের সাথে তাঁকে বেল্ট দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়েছে। একটা ভেন্টিলেটার দিয়ে সামান্য আলো আসছে সেই ঘরে—সেদিকে তাকিয়ে বুঝলেন, এখন দিন। একটা অন্ধকার ঘরে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছে।
ততক্ষণে মূর্তিটা বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
আমাকে কেন আটকে রেখেছো? আমার টাকা পয়সা নেই, রুগী মানুষ, ছেড়ে দাও আমাকে।
টাকা পয়সা আমার অনেক আছে, হেকমত সাহেব। আপনার কাছে চাই না।
তবে? আর কি চাও আমার কাছে?
ঘরের মধ্যে বাতি জ্বলে উঠলো। কালো আলখেল্লা পরা একজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘরের মধ্যে। কেমন যেন চেনা ঠেকছে চেহারাটা। লোকটা বললো, আপাততঃ আপনার জ্ঞান ফিরে আসাটা চাইছিলাম।
ঘরের এক কোণে আর একজন লোককে দেখা গেল। নিকষ কালো তার গায়ের রঙ। একটা হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পরনে। খুব রোগা লোকটা। একটা টেবিলের ওপর নানান আকারের কতগুলো যন্ত্রপাতি সাজিয়ে রাখছিল সে। আলখেল্লা পরা লোকটার দিকে ফিরে বললো, সব ঠিক আছে, হুজুর। মাইক্রোস্কোপটা আমি পাশের ঘর থেকে নিয়ে আসছি।
পাশের ঘরে চলে গেল সে। আলখেল্লা পরা লোকটা এবার ঠেলা দিয়ে খাটটা টেবিলের কাছে নিয়ে গেল। খাটের পায়াতে রবারের চাকা লাগানো। নিঃশব্দে সেটা গড়িয়ে চলে এলো। একটা যন্ত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো লোকটা।
আমাকে নিয়ে কি করতে চাও? হেকমত আলী সভয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
করতে চাই। যন্ত্রটা নামিয়ে রাখলো লোকটা টেবিলের উপর। অনেক কিছুই করতে চাই, হেকমত সাহেব। আজ আমার সারা জীবনের সাধনার হয় ফল লাভ করবো, নয়তো চিরকালের জন্যে শেষ হয়ে যাবো। আজ ছয় ঘণ্টার মধ্যে আপনি হয় যক্ষ্মার হাত থেকে বেঁচে যাবেন, নয়তো মৃত্যুবরণ করবেন। ও কি, চমকে উঠবেন না। মরতে তো আপনাকে হবেই, আজ যদি একটা মহৎ উদ্দেশ্যে আপনি মারা যান তাহলে কি আপনার মৃত্যু মহিমামন্ডিত হয়ে উঠবে না? আর যদি successful হই, তবে পৃথিবী থেকে ক্ষয় রোগ চিরকালের জন্যে দূর হয়ে যাবে।
আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আরোগ্য চাই না। যে কটা দিন পারি, সে ক টা দিন আমি বাঁচতে চাই।
আপনি চাইলেও আপনাকে ছাড়া হবে না। আমার পরীক্ষা আমি করবোই। কারও সাধ্য নেই তা ঠেকাবার। আমাকে বাঁধা দেবার জন্যে গুলিও ছুড়েছিলেন, পেরেছেন আটকাতে। এই গবেষণার জন্যে আমি কতো মানুষ খুন করেছি-ডাকাতি করে টাকা যোগাড় করেছি। এখন আপনার অনিচ্ছায় সবকিছু আমি ভেস্তে দেবো বলতে চান, হেকমত সাহেব?
মাইক্রোকোপ নিয়ে কালো লোকটা ফিরে এলো। সাবধানে টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলো যন্ধটা। প্যান্টের দু পকেট থেকে দু বোতল স্কচ হুইস্কি বের করে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখলো। আলখেল্লাধারী বললো, হেকমত সাহেবের গায়ের জামা সব খুলে ফেলো তো। আরে, ও কি করছো? কেবল শার্ট আর গেঞ্জি, পাজামা থাক।
হেকমত সাহেবের গা থেকে শার্ট আর গেঞ্জি খুলে ফেললো কালো লোকটা। সব কটা হাড় দেখা যায়। ভয়ে তার মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। টেবিলের উপর যন্ধটা বসিয়ে তার মুখটা এদিকে ওদিকে ঘুরিয়ে ঠিক হেকমত আলীর বুকের দিকে ফিরিয়ে আলখেল্লাধারী একটা সুইচ টিপে দিলো। তারপর বললো, এখন থেকে ছ ঘন্টা পর আমার গবেষণার ফল জানতে পারবো। আপনার শরীর খুব দুর্বল তাই খুব কম পরিমাণে sound পাঠাতে হচ্ছে। আরও তাড়াতাড়ি কাজ সারা যেতো যদি পয়েন্ট জিরো ওয়ান কিলোসাইকলসে সেটা পাঠাতে পারতাম।
হেকমত সাহেব কিছুই বুঝলেন না। কেমন যেন বিম বিম করছে মাথাটা। আড়ষ্ট
কষ্ঠে বললেন, তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
আলখেল্লাধারী একটা বোতল তুলে নিয়েছিপি খুলে বেশ অনেকখানি তরল পদার্থ গলায় ঢাললো। তারপর একটু কেশে গলা পরিস্কার করে বললো, বুঝতে পারছেন না? আপনি আল্টা সোনিক্স সম্বন্ধে কিছু জানেন?
নাম শুনেছি। অতি শব্দ। যে শব্দ শোনা যায় না।
ঠিক ধরেছেন। কিন্তু হয়তো জানেন না, এই আলা সোনিক্স দিয়ে কতো বড় বড় কাজ করা যায়। আমি এটা নিয়ে গবেষণা করেছি সুদীর্ঘ পনেরো বছর। এই যে যন্ত্রটা দেখছেন আপনার বুকের দিকে তাকিয়ে আছে, এটা অনবরত অতি সূক্ষ্ম শব্দ তরঙ্গ পাঠাচ্ছে আপনার বুকের দিকে। ফলে ক্ষয় রোগের যতো জীবাণু আসছে হার্টে, আর যতো বীজানু বহুদিন থেকে বাসা বেঁধেছে লাংসে, সব মারা পড়ছে। ছ ঘন্টার মধ্যে সব মরে ভূত হয়ে যাবে, যদি আমার হিসেব ঠিক হয়ে থাকে। তারপর আপনি ভালো খাওয়া দাওয়া করলে তিন মাসের মধ্যে আবার আগের স্বাস্থ্য ফিরে পাবেন।