কামালের মুখটা হাঁ হয়ে গেছিলো। সামলে নিয়ে অতি কষ্টে রাগ চেপে মেয়েটির দিকে চেয়ে বললো, আর আমাদের ঠিকানা দিয়ে যাচ্ছি, ওকে বলবেন যদি কিছু মনে না করে তাহলে যেন দয়া করে গিয়ে কামাল আহমেদ আর শহীদ খানের বুকে দুটো বুলেট ঢুকিয়ে দিয়ে আসে।
এর এই চাপা রাগ দেখে শহীদ হেসে ফেললো। আরও রেগে গিয়ে কামাল বললো, তোমার তামাশা আমি বুঝি না শহীদ। লোকটাকে হাতে পেয়ে ছেড়ে দেয়ার কি অর্থ হতে পারে? তুমি তো মরতে বসেছিলে ওর হাতে। এখন আবার অতো দয়া কেন?
রেগে গেলে সে শহীদকে তুমি করে বলে। শহীদ ওর কাঁধে হাত রেখে বললো, আয় কামাল, পথে যেতে যেতে সব বুঝিয়ে দেবো। এখন আয়, দেরি করিস না, আমাদের জরুরী কাজ আছে।
হোটেলে ফিরে এলো ওরা নিরাপদেই। গফুর মাটিতে একটা বিছানা পেতে কাঁথা জড়িয়ে বসে পুঁথি পড়ছিল, হরিদাস বসে শুনছিল। অপরিচিত লোক দেখে হরিদাস একটু আশ্চর্য হলো। এতো রাতে আবার কোনো ভদ্ৰলোক কারও সাথে দেখা করতে আসে? নিচে চলে গেল ও।
বেশ বদল করে ওরা রফিকুল ইসলামের বাড়ি গিয়ে হাজির হলো। খাটের উপর বসলো শহীদ, কামাল বসলো একটা চেয়ারে। যন্ত্রে ইতিমধ্যেই সুর মিলিয়ে রেখেছে রফিক। রাত প্রায় দেড়টায় আসর ভাঙলো। কামাল ঝিম হয়ে রয়েছে। দরবারী বাজালো আজ রফিক। এগিয়ে এসে কামাল হঠাৎ রফিকুল ইসলামের পায়ের ধুলো নিলো। সসব্যস্ত হয়ে উঠলো রফিকুল ইসলাম। লজ্জা পেয়ে বললো, ও কি করেন। আপনি আমার চাইতে বয়সে অনেক বড়। ছি, ছি!
যখন কামাল উঠে দাঁড়ালো তখন তার চোখে জল। রফিকের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর মৃদুস্বরে বললো, গুণী। শিল্পী! আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি নাও।
কামালকে জড়িয়ে ধরলো রফিক। বললো, আমায় যে বোঝে সে আমার চাইতে কোনো দিক দিয়ে ছোটো নয় আবিনাশ বাবু। আপনারা আমার বিশ্বাস ভেঙে দিচ্ছেন দুজন মিলে। আমি কোনোদিন ভাবতে পারিনি যে কেউ আমার গান বুঝবে, অনুভব করবে। সঙ্গীত বুঝতে হলে চাই উদার মন। আপনাকে কি করে যে আমার ভালোবাসা জানাবো বুঝতেই পারছি না, অবিনাশ বাবু।
কামাল রফিকের বাহুপাশ থেকে ছুটে বললো, কাল আবার আসতে পারবো তো?
নিশ্চয়ই। কাল এগারোটার সময় আসবেন। আজ কিন্তু আপনারা বেশ দেরি করে এসেছিলেন।
কাল ঠিক সময়ে আমরা পৌঁছোবো, রফিক সাহেব। শহীদ বলে। আর এখন আমরা আসি।
চাকরটাকে কফি আনতে বলেছিলাম। ও বোধহয় আমাদের disturb হবে ভেবে এতক্ষণ আনেনি। একটু বসো, কফি খেয়ে যাও।
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই রফিকের মিশমিশে কালো চাকরটা এসে ঢুকলো ঘরে। একটা ট্রেতে করে ককি আর কয়েকটা বিস্কিট এনেছে।
একটা বোতল খুলে কিছু raw gin গলায় ঢেলে দিলো রফিক। বড় সুন্দর দেখাচ্ছে আজ রফিককে। একমাথা কোঁকড়ানো চুল। অপূর্ব সুন্দর চোখ দুটোতে আজ যেন একটা স্বপ্নের আবেশ। বড় ভালো লাগছে ওকে। একটা গাঢ় চকোলেট রঙের আলোয়ান গায়ে জড়িয়ে বসেছে ও। মিষ্টি হেসে বললো, জানো, আজ আমার জন্মদিন।
তাই নাকি? আগে বলোনি কেন? শহীদ বললো।
কেন, কিছু প্রেজেন্ট করতে বুঝি? আমি প্রেজেন্টেশন নিতে ভালবাসি না।
ভালো কথা।
আচ্ছা, আপনি বিটোফেনের সুর ভালবাসেন, অবিনাশ বাবু?
হাঁ। অবশ্য ভালো বুঝি না। কিন্তু মন্দ লাগে না।
কাল এসো, তোমাদের কয়েকটা জার্মান সুর বাজিয়ে শোনাবো। হ্যাঁ, হ্যাঁ, সরোদেই, আর কিছু আমি জানি না বাজাতে। শহীদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে হেসে বলে রফিকুল ইসলাম।
আপনি ওদেশের সঙ্গীতও জানেন? জিজ্ঞেস করে কামাল।
এই সামান্য কিছু। আমি পনেরো বছর জার্মানীতে ছিলাম।
জার্মানীতে? বিস্মিত হয় শহীদ, কামাল।
হ্যা। সে অনেক কথা। আরেকদিন শুনবেন। আজ না, কেমন? কয়েক ঢোক মদ খায় রফিকুল ইসলাম।
পরদিন সকালে শহীদ আর কামাল চা খাচ্ছে, এমন সময় চিঠি হাতে একটা বাচ্চা ছেলে এসে দাঁড়ালো দরজার সামনে। বললো, আপা চিঠিটা দিলেন, বুললেন খুব জরুরী।
চিঠিটা পড়ে শহীদের ভ্রু কুঁচকে গেল। কামালের হাতে দিলো চিঠিটা। কালকের সেই মেয়েটির লেখা। লিখেছেঃ
শহীদ ভাই,
কাল মাঝরাত থেকে বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না। রাত তিনটের দিকে গরম জল নিয়ে দেখি গিয়ে বাবা বিছানায় নেই-জানালার সব কটা গরাদ বাঁকানো এখনো পুলিসে খবর দিইনি। বড় বিপদে পড়েছি। আপনি শিগগির একবার আসুন।
ইতি—মহুয়া
এক মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে ওরা বেরিয়ে পড়লো। রিক্সায় কামাল জিজ্ঞেস করলো, মেয়েটা হিন্দু নাকি রে!
না। মুসলমান। ওর বাবার নাম হেকমত আলী। কুষ্টিয়া মিউনিসিপ্যাল স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন। বছর পাঁচেক থাইসিসে ভুগছেন-বিছানায় পড়ে আছেন। মেয়েটি বি.এ. পড়ছে। গার্লস স্কুলে মাস্টারি করে আর পড়ে। সংসারও সেই চালায়।
রিক্সা এসে থামলো বাড়িটার সামনে। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ওরা এগিয়ে গেল। বাইরে থেকেই দেখা গেল জানালার সব কটা গরাদ বাকানো। মহুয়া বেরিয়ে এলো। মুখটা শুকিয়ে গেছে সারারাত্রির চিন্তায়। কিন্তু বড় সুন্দর দেখাচ্ছে। কামাল লক্ষ্য করলো মেয়েটি অদ্ভুত সুন্দরী। বয়স আঠারো কুড়ির মধ্যে। চমৎকার গড়ন, রঙটা উজ্জ্বল গৌর। মুখ দেখে কেউ বুঝবে না ঐ মেয়ে কঠোর সংগ্রাম করছে বেঁচে থাকবার জন্যে। টানাটানা চোখগুলো বড় গভীর। সমস্ত মুখটায় একটা নিস্পাপ সারল্য আছে।