একটা রুমাল আর একগাছা সিল্কের দড়ি বের করে দিলো শহীদ। তারপর মাটি থেকে রিভলবারটা তুলে নিলো।
ঠিক সোয়া দশটার সময় দূর থেকে একটা ঘোড়ার গাড়ির শব্দ শোনা গেল। কামাল বললো, গলির মুখে এসে শব্দটা থেমে গেল বলে মনে হচ্ছে।
হা। থামবে। সময় উপস্থিত। ফিসফিস করে বলে শহীদ। রিভলবার হাতে করে দাঁড়া। ওকি কাপছিস কেন? ভয় লাগছে?
গায়ে কাপড় নেই, শীত করছে।
শহীদ তার গায়ের কোটটা খুলে কামালের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলো। স্নেহের সুরে বললো, গাধা। ভিক্ষার থলেতে একটা আলোয়ান আনতে পারিসনি?
কামাল কি যেন বলতে যাচ্ছিলো। তার মুখ চেপে ধরে শহীদ ফিসফিস করে বলে, চুপ! ঐ দেখ আসছে। ওরই নাম কুয়াশা! সামান্যতম আওয়াজ হলেই ও টের পেয়ে যাবে। একদম চুপ।
কাছে এলে গুলি করবো?
খবরদার। আমার আদেশ ছাড়া কিছু করবি না৷
একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। যেমন লম্বা, তেমনি চওড়া। পায়ের তালে তালে কেবল একটা হাত দুলছে। আরেকটা হাত স্থির। শহীদ একটু অবাক হয়। না, আরেকটা হাতও আছে – সে হাতে একটা বাক্স মতো কি ঝোলানো।
সন্তৰ্পণে এগিয়ে আসছে কুয়াশা। কামালের বুকটা হিম হয়ে আসে। এই লোকটাই অবলীলাক্রমে মানুষ খুন করে বেড়াচ্ছে। এই যে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে লোকটা, সে একজন খুনী, ফাঁসির আসামী।
ওদের ঝোপের থেকে রাস্তা হাত পাঁচেক দূরে। ঠিক ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো কুয়াশা। চারদিকে সন্তৰ্পণে একবার চাইলো। তারপর বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। খোলা জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো কুয়াশা। বাক্সটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো। তারপর জানালার একটা শিকের ওপর ধরলো বাক্সটা।
শহীদ পকেট থেকে কি একটা বের করে তাতে ফুঁ দিলো৷ দুবার। ঘেউ। ঘেউ। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দুবার ডেকে উঠলো একটা কুকুর। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বন্দুকের প্রচন্ড এক আওয়াজ। ধ্বনি প্ৰতিধ্বনি তুলে অনেকক্ষণ ধরে শব্দটা এ বাড়ি ওবাড়ির দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরতে লাগলো। স্যাৎ করে সরে গেল কুয়াশা জানালার ধার থেকে। একটা অন্ধকার জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর দ্রুতগতিতে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। উদভ্রান্তের মতো কামাল রিভলবার তুললো। শহীদ চেপে ধরলো তার হাত। কয়েক সেকেন্ড একটা গাছের এপারে বাড়িটা থেকে আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো কুয়াশা। তারপর দৌড় দিলো বড় রাস্তার দিকে। একটু পরেই আবার ঘোড়াগাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। ধীরে মিলিয়ে গেল শব্দটা।
আবার শিঙাটা নিয়ে শহীদ তিনবার কুকুরের ডাক ডাকলো। ঘরের ভিতর একটা আলো দেখা গেল একটু পরেই। দরজা খুলে হ্যারিকেন হাতে একটা মেয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। আপনি কোথায়, শহীদ ভাই? মেয়েটি জোরে ডাকে।
এই তো এখানে। হ্যারিকেনটা নিয়ে এই দিকে আসুন।
আলোটা এগিয়ে এলো। মেয়েটি ব্যগ্ৰ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, সে এসেছিল শহীদ ভাই? ওখানে কি পড়ে রয়েছে? আরে অনেক রক্ত যে? মেয়েটির গলা কেঁপে ওঠে।
লোকটা তখনও জ্ঞান ফিরে পায়নি। শহীদ ওকে অনায়াসে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো। তারপর মেয়েটিকে বললো, আপনি আলো ধরুন সামনে। হ্যাঁ, এখন চলুন বাসার দিকে। এর জ্ঞান আগে ফিরিয়ে আনি, তারপর একটা কিছু ব্যবস্থা করা যাবে। আপনার বাবা সুস্থ আছেন তো?
হ্যা। বাবা মোটেও ভয় পাননি। বাব্বা, আমার কী ভয় যে করছিল।
বৈঠকখানার দরজা খুলে দিলো মেয়েটি। ঘরের মধ্যেখানে লোকটাকে শুইয়ে দিয়ে শহীদ বললো, আপনি একটা ন্যাড়া ভিজিয়ে আনুন তো শিগগির।
মেয়েটি বেরিয়ে গেল দ্রুত পায়ে। ফিরে এসে ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে লোকটার মুখের রক্ত মুছে দিলো। মাথার একটা জায়গা বেশ অনেকখানি কেটে গেছে, রক্ত বন্ধ হয়েছে অনেকক্ষণ। লোকটার মুখে চোখে জল ছিটাতে লাগলো সে।
কামাল আর শহীদ বাইরে এসে জানালার সামনে দাঁড়ালো। এইখানেই দাঁড়িয়েছিল কুয়াশা। একটা শিকের নিচের দিকটা গলে গেছে। কয়েক ফোটা গলা লোহা পড়ে রয়েছে। কামাল শহীদের দিকে চাইলো, শহীদও কামালের দিকে চাইলো। কেউ কোনও কথা বললো না। ঘরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে কামাল হঠাৎ উত্তেজিত কণ্ঠে বললো, তোর জন্যে শহীদ, কেবল তোর জন্যে আজ কুয়াশা পালিয়ে যেতে পারলো। নইলে আমি ওর বুকের মধ্যে বুলেট ঢুকিয়ে টের পাইয়ে দিতাম খুন করবার মজা।
উত্তেজিত হোস না কামাল। মাথা ঠান্ডা কর। ওকে খুন করলে পুলিস তোকে ধরতো খুনের দায়ে। কিছুতেই তুই প্রমাণ করতে পারতিস না যে ও-ই কুয়াশা। ওর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই।
অন্তত ওকে আহত করে বন্দী করা তো অসম্ভব ছিলো না।
অসম্ভবই ছিলো, কামাল। ওর হাতে একটা বাক্স দেখেছিস না? ওটা আমাদের দিকে ধরে একটা বোতাম টিপলে আমাদের ভবের লীলা সাঙ্গ হতে এক সেকেন্ডও লাগতো না। ওকে আহত করবার অর্থ নিজের মৃত্যু নিজে ডেকে আনা।
শহীদের কথায় বিশেষ সন্তুষ্ট হলো না কামাল। অন্য দিকে মুখ ফুরিয়ে বসে রইলো। হঠাৎ একটা কথা মনে হওয়াতে শহীদ মেয়েটির কাছে কাগজ কলম চাইলো। খশ খশ করে কি কি সব লিখলো। তারপর ভাঁজ করে মেয়েটির হাতে দিয়ে বললো, আমাদের খুব জরুরী কাজ আছে। আমরা এখুনি চলে যাচ্ছি। লোকটার জ্ঞান হলে এ চিঠিটা ওকে দেবেন, আর এই যে ওর রিভলবার, এটাও। বলে শহীদ চিঠি আর রিভলবার দিলো মেয়েটির হাতে।