বাথরুম থেকে আওয়াজ এলো, প্রলয়। আমার তোয়ালেটা দে তো বাক্স থেকে বের করে, ফেলে এসেছি।
গফুর সচেতন হয়ে গেল। সে বাক্স খুঁজে বললো, নেই তো বাবু আপনার তোয়ালে বাক্সের মধ্যে।
ওহ-হো। এই তো কাপড়ের তলায় ছিলো। লাগবে না যা, পাওয়া গেছে।
গফুর নিচে গেল। রফিকুল ইসলাম বললো, ঢাকায় তোমার বাড়ি আছে বুঝি?
ছিলো। এখন ভাড়া দিয়ে দিয়েছি। আমি এখন রায়পুরাতেই থাকি।
হঠাৎ রফিকুল ইসলাম উঠে দাঁড়ালো। আমাকে এখুনি যেতে হচ্ছে, অনাথ বাবু। আমার মনেই ছিলো না একখানে এনগেজমেন্ট আছে। তুমি এগারোটার সময় অবিনাশ বাবুকে নিয়ে আমার বাসায় এসো।
ত্ৰস্ত পদে বেরিয়ে গেল রফিকুল ইসলাম। এইমাত্র কোথা থেকে যেন একটা টেলিগ্রাম এসেছে। সেটা পড়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ভুলে টেবিলের উপর ফেলে গেছে সে। সেটা খুলে একবার চোখ বুলালো শহীদ, তারপর আবার যথাস্থানে বন্ধ করে রেখে দিলো।
কিছুক্ষণ পরই রফিকুল ইসলাম ফিরে এলো। টেলিগ্রামটা ভুলে রেখে গেছিলাম, বলে সেটা উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল।
খাওয়া দাওয়ার পর কামাল বললো, কোনো সূত্র পেলি এতদিনে?
কিছু কিছু পেয়েছি, কিন্তু আরও বড় প্রমাণ চাই।
কাকে তোর সন্দেহ হয়?
সে পরে শুনিস। এখন তোকে আমি একটা কাজ দেবো। চটপট তৈরি হয়ে নে।
কি কাজ?
আমার পেছনে একজন লোক ঘুরছে কদিন ধরে। তার ওপর তোর নজর রাখতে হবে। জানালা দিয়ে চেয়ে দেখ, ঐ যে লোকটা দেখা যাচ্ছে পান কিনছে মোড়ের দোকানে, ভালো করে চিনে রাখ ওকে। আজ রাতে একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। আমাকে বাইরে যেতে হবে তার জন্যে। আমার পেছনে এ লোকটা লেগে থাকবে। তুই শুধু খেয়াল রাখবি যেন লোকটা আমাকে বেকায়দায় না পায়। দরকার হলে রিভলবার ছুড়বি। মেরে ফেলিস নে আবার। জখম করবি শুধু।
কি ব্যাপার আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, শহীদ। কোথায় দুর্ঘটনা ঘটবে? এই লোকটাই বা কে?
বোঝাবার সময় নেই! এখন নয়টা বাজে। আর সময় নেই। আমি তৈরি হয়ে নিই, তুইও একটা কিছু পরে নে। আমার পাঁচ মিনিট পর তুইও বেরিয়ে যাবি হোটেল থেকে। খবরদার, লোকটাকে চোখের আড়াল করবি না। তাহলে তুই আর মজমপুর চিনবি না। আমি খুব বিপদে পড়তে পারি।
ঠিক হ্যায়। আমি ঠিক নজর রাখবো। ঐ ব্যাটা ঘোতকাকে আর আমার চোখ এড়াতে হচ্ছে না।
কালো স্যুট পরা একজন দীর্ঘাকৃতি যুবক আদর্শ হিন্দ হোটেল থেকে বেরিয়ে গেল। ম্যানেজার একবার তাকালো তারপর নিজের কাজে মন দিলো। লোকটা বোধহয় জমিদার বাবুর কাছে এসেছিল।
তার মিনিট পাঁচেক পর একজন অতি বৃদ্ধ ভিক লাঠি হাতে, একটা ছেড়া থলে গলায় ঝুলিয়ে হোটেলের পিছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। শীতে তার হাত পা কাঁপছে। অতি অপরিষ্কার ছেড়া কাপড় দিয়ে যতোটা সম্ভব শীত থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করছে।
থানাপাড়ার রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে যুবক। রাস্তার একপাশে সারি সারি বন্ধ দোকান। এদিকটা এমনিতেই নির্জন তার উপর আজ রবিবার-সারাদিনই দোকান-পাট বন্ধ। পথিকের জুতোর শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দোকানগুলোর বদ্ধ দরজায়। লাইট পোস্টের নিচে তার ছায়াটা ছোট হয়ে আসে, আবার বড় হতে হতে মিলিয়ে যায়। আরেকটা পোস্টের কাছে এসে ধীর অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে বরাবর হেঁটে এসে দাঁড়ালো সে একটা মোড়ের কাছে। ডান দিকে একটা কাঁচা রাস্তা। মেইন রোডটা বা দিকে ঘুরে রেল লাইন পেরিয়ে চলে গেছে পশ্চিম দিকে। কোনও দিকে না তাকিয়ে এই কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে চললো সে। এক হাঁটু ধুলো রাস্তায়। বরাবর কিছুদর এগিয়ে একটা একতলা বাড়ির ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো যুবক। একেবারে নির্জন এলাকায় বাড়িটা, আশে পাশে আর কোনো বাড়ি নেই। আর সিকি মাইলটাক পুবে এগোলেই গড়াই নদী। বাড়িটার উল্টো দিকে রাখার ওপাশে বেশ বড় একটা মাঠ। তারও দক্ষিণে কয়েকটা বাড়ির পিছন দিক। মাঠটা জঙ্গল হয়ে আছে আগাছায়। ছোট ছোট ঝোপ। মাঝে মাঝে বড় বড় গাছও আছে। রাস্তাটার ডান ধারে লাইন করা কতকগুলো জিগে গাছ। লোকটা ঢুকে পড়লো জঙ্গলে। বাড়িটার উপর ভালো নজর রাখা যায় এমন একটা জায়গা বেছে নিয়ে সে স্থির হয়ে দাঁড়ালো।
বাড়িটার দক্ষিণ দিকে একটা জানালা খোলা। একটা ক্ষীণ আলো জ্বলছে ঘরের ভিতর। আশে পাশে কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই। ঘড়িটার দিকে চাইলো যুবক! দশটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। পকেট থেকে কি একটা শাখের মতো জিনিস বের করে মুখে লাগিয়ে ফু দিলো। ঘেউ করে একটা শব্দ হলো জোরে। ঠিক যেন অ্যালসেশিয়ান কুকুরের ডাক। সাথে সাথেই ঘরের ভিতরের আলোটা নিভে গেল।
চুপ করে দাড়িয়ে আছে যুবক। মাঝে মাঝে মুখের সামনে হাত নাড়ছে। বড্ডো বেশি মশা।
হঠাৎ ঘাড়ের কাছে ঠান্ডা একটা শক্ত জিনিসের স্পর্শ পেলো সে। চমকে ঘুরে দাঁড়ায় যুবক। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। শুধু একটা ছায়ামূর্তি তার সামনে দাড়িয়ে আছে বোঝা যায়।
হ্যান্ডস আপ। চাপা অথচ গভীর গলায় আওয়াজ এলো।
যুবক দুহাত উপরে তুলে দাঁড়ায়।
বাছাধন। ভেবেছো ছদ্মবেশ পরে খুব ফাকি দিলে। এইবার তোমার সব জারিজুরি বের করবো। যুবকের পকেটে হাত দিয়ে রিভলবারটা বের করতে গেল আগন্তুক। মুখে তার ক্রুর হাসি।
হঠাৎ কি হতে কি হয়ে গেল। খট করে একটা শব্দ হলো। আগন্তুকের হাত থেকে ছিটকে রিভলবার মাটিতে পড়লো। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে লোকটা। আরেকটা শব্দ, খট। কিছু-মাত্র শব্দ না করে লোকটা জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এবার যুবক কথা বললো, ঠিক সময়ে এসে পড়েছিলি, কামাল! জব্বর মার মেরেছিস, এখন নে, রুমালটা ব্যাটার মুখে পুরে দে, আর এইটা দিয়ে ভালো করে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেল। আমি মোটেই টের পাইনি ব্যাটা আমার এতো কাছে ছিলো।