মহা ভাবনায় পড়লো শহীদ। তাহলে কি কুয়াশার দৃষ্টি পড়েছে তার উপর। নাকি বেটা ছিচকে চোর? কিন্তু তাহলে জিনিস কিছুই চুরি হলো না কেন? দেখা যাক কি হয়, শহীদ ভাবে। তবে সাবধানে থাকতে হবে। পুলিসে খবর দিয়ে লাভ নেই, শুধু শুধু হাঙ্গামা করবে পুলিস এসে। হয়তো হরিদাসকে ধরেই মারতে লেগে যাবে। একবার ভাবলো রফিকের বাসায় উঠে যাবে কিনা।
জিনিসপত্র তুলে যথাস্থানে সাজিয়ে রাখলো শহীদ। কাউকে কিছু জানালো না। কিছুক্ষণ পর হরিদাস এসে বললো, বাবু আপনাকে একজন খুঁজতে এসেছিল সোন্দোর পর।
তার নাম বলে গেছে?
আজ্ঞে না। আমি জিজ্ঞাসা করেছেলাম। বুললো না। আমি বুললাম আপনি রফিক সাহেবের বাসায় যেয়েছেন। সে নোক অনেকক্ষণ নিচের রেস্টুরেন্টে বইসেছেল আপনার জন্যি। তারপর কখন যে উইঠে চইলে গেল দেখিনি। আপনার সাথে দেখা হোইনি বাবু?
না হয়নি। আবার কখন আসবে লোকটা বলে গেছে?
না বাবু।
কি রকম দেখতে লোকটা?
বাইটে মতোন। মোটাসোট। হাতে একটা ছোট বাক্স ছেলো। সাদা শার্ট আর পাজামা পইরে ছেলো।
শহীদ খেয়াল করে দেখলো আজ হোটেলে ঢুকবার সময় পিছন থেকে যাকে দেখেছে তার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে ওর বর্ণনা। একটা টাকা বের করে হরিদাসের হাতে দিয়ে বললো, আচ্ছা, তুমি এখন যাও হরিদাস। এরপর কেউ আমাকে খোঁজ করলে তাকে বসিয়ে রেখে আমাকে খবর দেবে।
হরিদাস চলে যাচ্ছে, তাকে আবার ডেকে শহীদ বললো, এখন চা পাওয়া যাবে না হরিদাস?
আজ্ঞে রাত বারোটা পর্যন্ত পাবেন।
কফি নেই।
আজ্ঞে, তাও আছে।
বাঃ। শহীদ খুশি হয়—এক কাপ কফি ভালো করে বানিয়ে আনে৷ তো।
ব্যালকনিতে বসে অনেকক্ষণ ধরে ধীরে ধীরে কফিটুকু খেলো শহীদ। তার মাথার মধ্যে জট পাকাচ্ছে একসাথে বহু চিন্তা। সে এখানে এসেছে খুনীর অনুসন্ধানে আজ পাঁচ ছয় দিন। কিন্তু কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছে সে? আজ হয়তো সে কুয়াশার তীক্ষ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে গেছে।
পর পর অনেকগুলো সিগারেট ধ্বংস করলো শহীদ গভীর চিন্তামগ্ন অবস্থায়। তার মুখে একটা দুর্বোধ্য রহস্যময় হাসি ফুটে উঠলো ধীরে ধীরে।
পরদিন নারাণ বাবুর সাথে দেখা করলো শহীদ রফিকুল ইসলামের সাথে গিয়ে। আরও কয়েকখানে গেল। আশরাফ চৌধুরীর বাড়িতেও একবার গিয়ে ঢু মেরে এলো। পথে ট্রেনের সেই সিরাজুল হকের সাথে দেখা। আদাব বিনিময় হলো। রফিক জিজ্ঞেস করলো, এই ভদ্ৰলোক, কে?
আমার সাথে ট্রেনে পরিচয়। বড্ডো গায়ে পড়ে আলাপ করছিল তাই প্রথমে আমার খারাপ লোক বলে সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু পরে আবার নদীর ধারে দেখা। মোহিনী মিলে কি একটা কাজ করে যেন বললো।
মোহিনী মিলে? অসম্ভব। আমি নানান ব্যাপারে প্রায়ই যাই মোহিনী মিলে। ওখানকার সব লোক আমার চেনা। এ লোক নিশ্চয়ই নতুন এসেছে কুষ্টিয়ায়। ছোট শহর এটা। এখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদের সবাই সবাইকে চেনে। তোমার কাছে মিছে কথা বলেছে লোকটা।
গতরাতের ঘটনা মনে পড়লো শহীদের। রফিকুল ইসলামকে বললো ব্যাপারটা। রফিক চিন্তিত হয়ে বললো, তাই তো। তোমার পেছনে চোর ছাচ্চোর লেগেছে বলে মনে হচ্ছে। well planned বলেই বোধ হচ্ছে, সেই ট্রেন থেকে follow করেছে তোমাকে। তুমি একটু সাবধানে থেকো। আর আপাততঃ চলো সোজা মোহিনী মিলে যাই। ওদের attendance register দেখলেই বোঝা যাবে সিরাজুল হক বলে কেউ ওখানে কাজ করে কিনা সত্যি সত্যিই।
রিক্সা ঘুরিয়ে ওরা মোহিনী মিলে গিয়ে উপস্থিত হলো। কর্মচারীদের অনেকেই রফিকুল ইসলামকে সসম্মানে সালাম দিলো। ম্যানেজার কি কাজে অফিস থেকে বাইরে এসে রফিককে দেখে হৈচৈ করে ডাকাডাকি শুরু করলেন। এ জায়গায় রফিকুল ইসলামের খুবই প্রতিপত্তি আছে বোঝা গেল। সেটা হয়েছে ম্যানেজারের সাথে বন্ধুত্বের পর থেকে।
খোঁজ করে দুজন সিরাজুল হক বেরোলো। ম্যানেজারের হকুমে তারা সামনে এসে দাঁড়ালো। আর কোনও সিরাজুল হক নেই। শহীদ আর রফিক অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা হোটেলে ফিরে এলো। কেউ লক্ষ্য করলো না, একজন লোক ম্যানেজারের অফিসের অদূরেই একটা গাছের আড়াল থেকে সব দেখলো। তারপর ধীর পদে বাজারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
১১.
কামালকে টেলিগ্রাম করলো শহীদ। সেদিনই বিকেলে কামাল আর গফুর এসে পৌঁছলো। সুন্দর মেকআপ হয়েছে কামালের। গফুরকেও চেনা যায় না।
সন্ধ্যের দিকে রফিকুল ইসলাম এসে বসলো শহীদের ঘরে। অনেক রকম কথা হচ্ছিলো। গফুরের প্রকান্ড কাঠামোর দিকে চেয়ে সে বললো, বাঃ, অদ্ভুত জিনিস পেয়েছো তো, অনাথ বাবু। তোমার নাম কি হে?
আজ্ঞে আমার নাম পেল্লয় বাগদী।
কিল মেরে কটা মানুষের মাথা একসাথে ভাঙতে পারো?
ও গোটা দুই পাঠান বা সাহেবকে চড় মেরে ঘুরিয়ে ফেলে দিতে পারে। শহীদ হেসে বললো।
গফুর সিধে রফিকের দিকে চেয়ে বললো, আজ্ঞে, দাদামণিকেও কিছু কম মনে করবেন না। আমার চাইতে তিনগুণ বেশি শক্তি আছে ওনার গায়ে। অনেকবার সে পরীক্ষা হয়ে গেছে।
শহীদ দেখলো, গফুর স্থান-কাল-পাত্র ভুলে যাচ্ছে। দাদামণির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ও এখনি বেফাঁস কথা বলে বসবে। রফিককে এড়িয়ে কয়েকবার চোখ টিপলো সে। গফুর দেখেই না। সে বলেই চলেছে, ঢাকায় বছর খানেক আগে একবার আমাদের বাড়ির সামনে কয়েকজন গুন্ডা ধরেছিল দাদামণিকে। সেই যে, প্ৰথম প্রথম দাদামণির মাথায়…