তা তো বটেই। এখন পর্যন্ত জায়গাটা আপনি দেখেনইনি। এখনই আপনার কাছ থেকে কোনো মতামত আশা করা যায় না।
এমন সময় রফিকুল ইসলাম বললো, কতখানি জমি কিনছেন আপনি? আমি কয়েকটা জমির খোঁজ দিতে পারি। ঐ তো মদনপুরের রহিমুদ্দিন ভূইয়া জমি বিক্রি করবে। এখানকার জমিদার নারাণ বাবু তার এষ্টেট গোটাই বিক্রি করে ইঙিয়া চলে যাবেন। গড়াই নদীর ওপারে কয়েকজন…
আপনি নাম ঠিকানাগুলো আমাকে লিখে দিন দয়া করে, নইলে আমার মনে থাকবে না বাধা দিয়ে বলে শহীদ। বলে বাক্স থেকে একটা নোটবুক বের করে দিলো রফিক সাহেবের হাতে। নাম-ঠিকানা কয়টা লিখে নোট বইটা শহীদের হাতে দিয়ে বললো, এদের সবার কাছেই আমার নাম বললে এরা খুব খাতির করবেন, দামের দিক দিয়েও হয়তো সুবিধা হতে পারে।
লেখাটার উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে শহীদ বললো, আমি এদের সাথে দেখা করবো। সম্ভব হলে কালই।
আশরাফ চৌধুরী চা খেয়েই উঠে গেলেন শহীদের একটা গোপন ইঙ্গিতে। শহীদ রফিক সাহেবকে বললো, চলুন না নদীর ধারে একটু বেড়িয়ে আসি? আমার পেটে আবার একটু গ্যাসট্রিক গোছের আছে কিনা, নদীর বাতাসটায় খুব উপকার হয়।
চলুন। উঠে দাঁড়ায় রফিকুল ইসলাম।
দুজনে একটা পাথরের উপর গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে রফিকুল ইসলাম বললো, রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ এখান থেকে কতদূর জানেন?
না। কত দূর?
মাত্র চার পাঁচ মাইল।
তাই নাকি, চলুন না, একদিন দেখে আসি?
চলুন কাল পরশু কোনো একদিন। আমার একটা লঞ্চ আছে, তাতেই যাওয়া যাবে, কি বলেন?
আপনার লঞ্চ আছে নাকি? কোথায়?
এখন সেটা গোয়ালন্দে, কাল এসে পৌঁছবে। এই সামনেই সেটা নোঙ্গর করে রাখি। আমার বিজনেসের জন্যে খুবই কাজে লাগে।
কিসের ব্যবসা করেন আপনি? জিজ্ঞেস করে শহীদ।
কিছু জামি আছে, তাতে আখ চাষ করি। আখের কল আছে তাতে গুড় তৈরি করি। অনেক আখ বাইরে থেকেও কিনতে হয়। সে গুড় ঢাকায় চালান করি। এছাড়া আরো কতগুলো প্রাইভেট বিজনেসও আছে—পারমিটের ব্যাপার।
গুড়ের ব্যবসায়ে লাভ কি রকম?
প্রচুর লাভ। ইনভেষ্টমেন্টের দ্বিগুণ। আপনাদের ওদিকে আখ কেমন হয় বলুন। তো? আমাদের ওদিকে আখের চাষ বিশেষ নেই, কিন্তু জমি আখের জন্যে খুব suitable. আর সস্তাও খুব, দুশ করে বিঘা আবাদী জমি। মাঝে মাঝে একশোও হয়, পঞ্চাশেও নামে।
বাঃ খুব সস্তা তো। ওদিকে ছেড়ে এদিকে জমি কিনতে চান কেন?
একটু রহস্যময় হাসি হেসে শহীদ বললো, ব্যাপার কি জানেন, আমি আসলে নারায়ণ বাবুর এস্টেট বিক্রির খবর পেয়েই এসেছি। কাউকে বলিনি। জানেনই তো, আমাদের সাথে সাথেই টাকা থাকে, ব্যাঙ্কে কিছু রাখি না, এই বিদেশ বিভূঁহয়ে চোর ডাকাত পড়তে কতক্ষণ?
আপনি সাথে করে সব টাকা এনেছেন বুঝি?
আপনি খেপেছেন। তাই সম্ভব? একটা বন্দোবস্ত হলে নায়েবকে টেলিগ্রাম করবো। সে-ই নিয়ে আসবে সব টাকা।
আপনার স্ত্রী কি রায়পুরাতেই আছেন নাকি অন্য কোথাও?
মুখটা গভীর হয়ে গেল শহীদের। বললো, আমি আজ দশ বছর ধরে বিপত্নীক। আর বিয়ে-থা করিনি। একটা৷ মেয়ে ছিলো, দুবছর হলো বিয়ে দিয়েছিলাম, সে-ও মাস ছয়েক হলো একটা বাচ্চা রেখে মারা গেছে।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। শহীদ বললো, আপনি বিয়ে করেননি বুঝি এখনও?
না। ইচ্ছেও নেই।
আপনি কি মনে করেন না জীবনটা ফুরিয়ে যাবার আগে ভোগ করে নেয়াই সমীচীন?
নিশ্চয়ই। জোরের সাথেই বলে রফিকুল ইসলাম, আপনার কথা ঠিক। কিন্তু সবার ভোগ তো সমান নয় অনাথ বাবু। আমিও ভোগ করছি জীবনটা। নইলে বাচি কি করে; তবে আমার ভোগে নারীর দরকার হয় না।
শহীদ আর কথা বাড়ায় না। তার কোন একটু শীত শীত করছে। সে বললো, এখন ওঠা যাক, রফিক সাহেব।
আপনি যান। আমি সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরবো। এই আমার নিয়ম। রোজ বিকেলে বসি, সঙ্ক্যের পর উঠি। পকেট থেকে একটা বোতল বের করে কিছু হুইস্কি গলায় ঢাললো সে। আসবেন আজ?
আসবো। আপনি বিরক্ত না হলে ঠিকই হাজিরা দেবো আপনার বাসায়।
১০.
কামালের চিঠি এলো। সে তার কথামতো কাজ করছে।
রফিকুল ইসলাম সম্বন্ধে আশরাফ চৌধুরীর কাছে অনেক কিছু জানতে পারলো শহীদ। আশরাফ অকুণ্ঠ প্ৰশংসা করেছে এই মানুষটার। বছর তিন হলো কুষ্টিয়ায় ব্যবসা করছে। অতি ভদ্রলোক। প্রচুর টাকা করেছে ব্যবসা করে।
রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ দেখে এসেছে শহীদ রফিকুলের সঙ্গে আজ দুদিন হলো। রোজ রাতে আসর বসে। রফিকুল ইসলামের বাড়ির উপরতলার একটা অংশ একেবারে তালা বন্ধ থাকে। শহীদ জিজ্ঞেস করায় রফিক হেসে বললো, একা মানুষ, কে থাকবে এতো বড় বাড়িতে চাকর আছে একটা, সে একতলার সম্পূর্ণটা জুড়ে থাকে। আমি অনেক চেষ্টা করেও এই তিনখানা ঘরের বেশি জুড়তে পারিনি। ওদিকটা খালিই পড়ে থাকে, তাই বন্ধ করে দিয়েছি।
ভাড়া দিলেই পারো। শহীদ বলে।
মফঃস্বল শহর, কে ভাড়া নেবে। তাছাড়া আমার সঙ্গীতের ধাকায় দুদিনেই ভাড়াটে পালাবে।
দুজনে হাসে। এতো কম সময়ে তাদের এতো গভীর বন্ধুত্ব জমে উঠবে কে, ভাবতে পেরেছিল? শহীদ কামালকে লিখেছে তার বন্ধুর কথা। লিখেছে, যেদিন শুনবি বাজনা, কেবল মাত্র সেদিনই বুঝবি, কী অদ্ভুত ভালো বাজায়।
সেদিন রাত দশটায় হোটেলে ফিরে আসছে শহীদ। হোটেলের দরজার কাছে আসতেই একজন লোক ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল পাশ কাটিয়ে। একবার তার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে শহীদ উপরে উঠে গেল। তার ঘরের দরজা খোলা। আশ্চর্য হয়ে গেল শহীদ ঘরে ঢুকে। সমস্ত ঘরে তার জিনিসপত্র ছড়ানো। কে যেন তার বাক্স ঘেঁটেছে লন্ড ভন্ড করে। প্রায় সবকিছুই বের করে মাটিতে টাল দেয়া। এক জোড়া স্যুট, কয়েকটা শার্ট, পাজামা, ধূতি, পাঞ্জাবী, সব মাটিতে বের করা রয়েছে। মেকআপ করবার জন্যে যে সব পরচুলা, পেইন্ট তার বাক্সে ছিলো, সবগুলোই মাটিতে নামানো। শহীদ লক্ষ্য করে দেখলো কিছুই চুরি যায়নি। টাকা আর রিভলবার তার সাথেই ছিলো।