আপনি উপরে আসুন আমি দরজা খুলে দিচ্ছি।
বাইরের দিকে একটা বাতি জ্বলে উঠলো। শহীদ দাঁড়িয়ে রইলো। একবার ভাবলো চলে যাবে কিনা কিন্তু আবার কৌতুহল হলো, দেখেই যাই লোকটাকে। এতোক্ষণে তার একটু শীত শীত বোধ হচ্ছে। রাত বোধহয় তিনটের কম না। দরজা খুলে যে লোকটা বেরিয়ে এলো, তাকে দেখেই শহীদ চিনতে পারলো। একেই সে দেখেছে আজ বিকেলে নদীর ধারে পাথরের উপর বসে থাকতে। লোকটা অত্যন্ত ভদ্র ভাবে বললো, আপনি আমার সাথে উপরে আসুন। শহীদ তার পিছন পিছন দোতলায় উঠে এলো।
শহীদকে একটা চেয়ারে বসতে অনুরোধ করে সে একটা ইলেকট্রিক স্টোভে এক কেটলি জল চড়িয়ে দিলো। তারপর ভালো করে শহীদের দিকে চেয়ে বললো, বাইরে শীতে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়েছে আপনার? আমাকে ডাকলেই পারতেন, মিছিমিছি এতো কষ্ট পেলেন অনাথ বাবু।
এখন মনে হচ্ছে কষ্ট লাগাই স্বাভাবিক ছিলো, কিন্তু তখন আপনার বাজনা শুনতে শুনতে ভুলেই গিয়েছিলাম কষ্টের কথা। বাগেশ্রীর ওপর এতো সুন্দর আলাপ জীবনে আর কখনও আমি শুনিনি। এর মধ্যে আপনাকে ডেকে বিরক্ত করি কি করে বলুন তো।
প্রশংসা শুনে মিষ্টি করে হাসলো ভদ্রলোক। চমৎকার ঝকঝকে দাঁত দেখা গেল।
আমার নাম রফিকুল ইসলাম। Businessman, ব্যস্ত মানুষ, সময় পাই না সাধবার। মাঝে মাঝে সারোদটা নিয়ে একটু বসি। কিন্তু তবলচি নেই এখানে ভালো–বড়ো অসুবিধা হয়। কিছুই বাজানো যায় না।
আমি অল-সল্প তবলা জানি। তবে আপনার সাথে সঙ্গতের মতো নয়।
আপনি জানেন বাজাতে? উজ্জ্বল হয়ে উঠলো শিল্পীর মুখ। আলমারির উপর থেকে এক জোড়া বাঁয়াতবলা পেড়ে বিছানার উপর রাখলো। তারপর বললো, আগে কফি খেয়ে নিই এক কাপ, তারপর কিছু একটা চেষ্টা করা যাবে, কি বলেন?
এক কাপ কফি এগিয়ে দিলো সে শহীদের দিকে, আরেক কাপ নিজে নিলো। কফি খেতে খেতে শহীদ তবলাটা বেঁধে নিলো। রফিকুল ইসলাম বললো, এই সময়টায় কোন রাগ শুনতে ইচ্ছে করছে আপনার বলুন তো?
ঝিঝিট ঠুমরী। একটু ভেবে উত্তর দেয় শহীদ।
ঠিক বলেছেন।
মিনিট কুড়ি ঝিঝিট চললো। উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলে শহীদ। বড় মিষ্টি হাত। অদ্ভুত সুরজ্ঞান রফিকুল ইসলামের বাজনা শেষ হতেই শহীদ বললো, উঃ! আপনাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। আপনি গুণী। কোথায় শিখেছেন এমন পাগল করা বাজনা?
আমি কারো কাছে শিখিনি। যেটুকু পেরেছি শুনে শুনে শিখেছি। ওস্তাদের পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়াবার সময় আমার ছিলো না। আপনি সত্যিকার সমঝদার, তাই আপনার কাছে ভালো লাগছে। আর কারো কাছে আমার বাজনা ভালো লাগবে না। আমি ওদের গ্রামার অনুসরণ কার না।
আমি তা বুঝেছি। কিন্তু পান্ডিত্য আর শিল্প দুটো আলাদা জিনিস। যা ভালো লাগে। যা মনকে মাতায় তাকে গ্রামার দিয়ে জবাই করা অন্যায়। আমার তো ধারণা ছিলো আবদুল করিম খাঁ সাহেবের বিঝিটের পরে আর কিছু সৃষ্টি হবে না। এইমাত্র আমার সে ভুল আমি শুধরে নিলাম।
রফিকুল ইসলাম দেরাজ টেনে একটা বোতল বের করলো। বললো, আপনার অভ্যেস নেই, তাই না?
Then excuse me. ছিপি খুলে চক চক করে কিছু বিলিতি raw gin গলায় ঢেলে বোতলের ছিপিটা বন্ধ করলো রফিকুল ইসলাম।
শহীদের সাথে তার আলাপ জমে উঠেছে। এরকম আলাপ আরও অনেকক্ষণ চলতে পারতো। শহীদের এতে ক্লান্তি নেই। আর অপর পক্ষেও যে নেই তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। এমন সময় দেয়াল ঘড়িতে টং টং করে রাত চারটে বাজলো। উঠে দাঁড়ালো শহীদ, আবার আপনার বাজনা শুনতে আসবো রফিক সাহেব, আজ আসি। আমার আবার সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। এখানে একটা জমি কিনবার ইচ্ছেয় এসেছি। একজন প্রফেসার কিছু জমি বিক্রি করছে, তার সাথে দরদস্তুর করতে হবে। আচ্ছা, আজ আসি।
গোট পর্যন্ত এগিয়ে দিলো রফিকুল ইসলাম। অনাথ চক্রবর্তী লোকটা বেশ। তবলায় বেশ হাত আছে লোকটার। লয়জ্ঞানও ভালো, ছোটো খাটো রেলা বড় চমৎকার বাজায়। মনটাও বড় সুন্দর। তাছাড়া সমঝদার।
৯.
বিছানায় শুয়ে শহীদ ভাবতে লাগলো রফিকুল ইসলামের কথা। ভদ্রলোক যে রকম সরোদ বাজায় সে স্ট্যান্ডার্ডে উঠতে হলে অন্ততঃ দশ বছরের কঠোর সাধনা চাই। একজন লোক, এতো যার সাধনা, সে আত্মপ্রকাশ করে না কেন? এতোবড় সাধক, মানুষের চোখে পড়লো না! কতো বড় প্রতিভাবান হলে কারো কাছে না শিখে এমন বাজানো সম্ভব! পৃথিবীতে কেউ জানবে না কতো বড় একজন শিল্পী অপ্রকাশিত রইলো।
বেলা প্রায় এগারোটায় শহীদের ঘুম ভাঙলো। মাঝে হরিদাস একবার দরজায় টোকা দিয়েছিল। ওকে বিরক্ত করতে মানা করে দিয়ে আবার ঘুমিয়েছে।
বিকেলে আশরাফ চৌধুরী এলো। সাথে সাথেই রফিকুল ইসলাম এসে ঢুকলো ঘরে। ওদের বসিয়ে সে চাকরকে ডেকে চা-বিস্কিট আনতে হকুম দিলো।
আশরাফ চৌধুরী অতি সাবধানে। দলিল, পরচা, নক্সা, ইত্যাদি বের করে টেবিলের উপর রাখলো। অতি বিচক্ষণের মতো শহীদ সে সব পরীক্ষা করে নানান রকম বৈষয়িক প্রশ্ন করলো। টুকে নিলো খাজনা কতো, টাকা বাকি আছে কিনা, জমি বরগা দিয়েছে কিনা, দাগ নম্বর কতো ইত্যাদি আরও কতো কি তথ্য। রফিকুল ইসলাম টেবিল থেকে একটা বই তুলে নিয়ে পাতা উল্টাতে লাগলো। শহীদ মনে মনে বললো, ভাগ্যিস বইটাতে নাম লিখিনি এখন পর্যন্ত!
আশরাফ সাহেবের দিকে ফিরে শহীদ বললো, আমার নায়েবকে চিঠি লিখে দেবো সে টাকা নিয়ে আসবে তারপর যা হয় একটা ব্যবস্থা করবো। আপনি এর মধ্যে চিন্তা করে দেখুন কিছু কমাতে পারেন কি না। আর আমিও এদিক ওদিক আরও কিছু খোঁজখবর করে দেখি কোথায় সুবিধা হয়।