শহীদ এগিয়ে যাচ্ছিলো, এমন সময় পিছন থেকে কে ডাকলো, অনাথ বাবু।
চমকে ফিরে তাকালো শহীদ। দেখলো ট্রেনের সেই লোকটা দ্রুত গতিতে তার দিকে আসছে। হাতে একটা অ্যাটাচি কেস। লোকটা কাছে এসেই বললো, দেখুন তো, পেছন থেকেও ঠিক চিনতে পেরেছি কেমন। হাওয়া খাচ্ছেন বুঝি?
হ্যাঁ, এই একটু ঘুরে বেড়াচ্ছি। লোকটার নামটা কিছুতেই মনে আনতে পারছে না শহীদ। ট্রেনে কি যেন একটা নাম বললো? একটু থেমে শহীদ আবার বললো, ত৷ আপনি এদিকে চললেন কোথায়? খুব তাড়া বুঝি?
এই তো, এই পথে আর একটু এগোলেই আমার বাসা। চাকরি করি সেই মোহিনী কটন মিলে। সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতে হলে একটু তাড়াতাড়ি হাটতে হয় বৈকি। বাসায় স্ত্রী আছেন কিনা, বুঝলেন না, তার হুকুমেই, মানে সাঁঝের আগেই ফিরতে হয়। চলুন না আমার বাসায় একটু চা খাবেন। গল্প-সল্প করা যাবে।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। এখন হোটেলে ফিরবো। আরেকদিন আপনার বাসায় চা খাওয়া যাবে, আজ আসি। শহীদ এক পা বাড়ালো।
ও, ভালো কথা, আপনার জমি কিনবার কি হলো? খোঁজ খবর পেলেন কিছু?
এই একটু আধটু খোঁজ পেয়েছি। আশরাফ চৌধুরী আছেন না, এখানকার কলেজের প্রফেসার, তিনি নাকি কিছু জমি বিক্রি করছেন। দেখি কথাবার্তা দামদর করে কি দাঁড়ায়।
ইংরেজির প্রফেসার আশরাফ চৌধুরী তো? উনি লোক খুব ভালো। তাঁর সাথে কারবারে আপনি ঠকবেন না। আচ্ছা, আজ আসি, আবার দেখা হবে।
দুজন দুদিকে চলে যায়। সেই লোকটি তখনও পাথরের উপরে বসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে ওপারের দিকে। সন্ধ্যা নামছে। আবছা হয়ে আসছে ওদিকের পাড়টা। কুয়াশা পড়ছে। দূরে একটা মন্দিরে ঘন্টা ধ্বনি হচ্ছে। কয়েকটা বাদুড় মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। নৌকোগুলোর কোনও কোনোটাতে আলো জ্বলছে। জলে তার প্রতিবিম্ব। কোনো এক বাড়িতে মশা তাড়াবার জন্যে ধূপ পোড়াচ্ছে, তার সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। মন্দিরে ঘন্টা পড়ছে টং টং। হোটেলে ফিরে এলো শহীদ। এতোক্ষণে মনে পড়েছে। লোকটার নাম সিরাজুল হক।
৮.
রাত দেড়টা। দুপুরে ঘুমিয়েছে তাই কিছুতেই শহীদের চোখে ঘুম আসছে না। ইংরেজি বইটা শেষ করে সুইচ টিপে বাতি নিভিয়ে দিলো। বিছানায় ঢুকে মশারীর চারিধারটা ভালো করে গুজে নিয়ে সে ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগলো।
হঠাৎ তার অত্যন্ত কান সজাগ হয়ে উঠলো। সরোদের আওয়াজ! এতো রাতে তো কোনও রেডিও- ষ্টেশন ধরবার কথা নয়। কোনও সঙ্গীত সম্মেলনও হতে পারে না। তার চোখ এড়িয়ে সম্মেলন হবার জো নেই। আর এতো রাতে সঙ্গীত সম্মেলন ছাড়া আর কোনও কারণেই রেডিও খুলবে না কেউ। হাত ঘড়িটার দিকে তাকায় শহীদ -রেডিয়াম দেয়া ঘড়ি-দেড়টা বাজে।
ধীরে ধীরে আলাপ হচ্ছে। বড় ভালো বাজাচ্ছে তো! কি বোল্ড টোকা! কি মিষ্টি। এক আলী আকবর খান ছাড়া আর কারও হাত দিয়ে এ টোকা বেরোবার কথা নয়। বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এলো শহীদ। জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। উঃ, অদ্ভুত সুন্দর বাগেশ্রী বাজাচ্ছে। এক টান দিয়ে দামী আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ঘরের দরজা ভিড়িয়ে বেরিয়ে এলো সে হোটেল থেকে। দেখতেই হবে এই মফঃস্বল শহরে কে এতোবড় শিল্পী।
আওয়াজ অনুসরণ করে এগিয়ে গেল শহীদ। নদীর পারের দোতলাটা থেকে শব্দ আসছে। সে গিয়ে দাঁড়ালো বাড়িটার কাছে। উচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়িটা। লোহার একটা গেট আছে। সটান গেট খুলে ভিতরে ঢুকে পড়লো শহীদ। দোতলায় বসে কে যেন বাজাচ্ছে। নিচে বারান্দায় উঠবার সিঁড়ির উপর বসে পড়লো শহীদ।
বেজে চলেছে সরোদ। কি অদ্ভুত মিষ্টি! স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গেল শহীদ। বুঁদ হয়ে বসে রইলো সিঁড়ির উপর। তার মনে হলো বাগেশ্রী যেন হেমন্ত কালের রাগ। সেই যে তার কিশোর বয়সে বিকেল বেলা সে আর কামাল পুরানা পল্টনের এক বাসায় ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতো। সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় সরু একটা পায়ে-হাঁটা পথ দিয়ে বাড়ি ফিরতো তারা। আশে পাশে ছোটখাটো ঝোপ, মাঝে মাঝে ঘন। মস্ত বড় বড় শাল গাছগুলোর তলায় আঁধার হয়ে এসেছে। পথের একধারে ছিলো একটা পুকুর। অজস্র লাল শাপলা ফুটে থাকতো তাতে। কুয়াশা পড়তো। ডোম-পাড়া থেকে ঘুটে পোড়ানোর গন্ধ আসতো। শিউলীর গভীর ভারি গন্ধটা নেশা ধরাতো। একটা দুটো করে বাতি জ্বলে উঠতো। সেই পুরোনো স্মৃতি জেগে উঠলো শহীদের মনে। তাদের গায়ে থাকতো হাতে বোনা সোয়েটার-প্রথম বের করা হয়েছে টাঙ্ক থেকে, তাতে ন্যাপথালিনের গন্ধ জড়ানো। শহীদের মনে হলো এখনও যেন সেই গন্ধ পাচ্ছে। সেই কিশোর বয়স। পৃথিবীটা কতো ছোটো তার কাছে তখন। মনটা তখন ঠিক কচি একটা গোলাপের কুঁড়ির মতো। বড় ভালো লাগে শহীদের। সাথে সাথে কষ্টও লাগে। ছোটকালের শহীদটাকে আদর করে দিতে ইচ্ছে করে তার।
তন্ময় হয়ে শোনে শহীদ। আলাপ ছেড়ে গৎ ধরলো বাদক। বড় সুন্দর অস্থায়ী অন্তরা। ষ্টাইল আছে, গায়কী আছে। খানদানী ঢং আছে।
কিন্তু তবলা নেই। কিছুক্ষণ বাজিয়ে বোধকরি বিরক্ত হয়েই থেমে গেল বাদক।
শহীদও বিরক্ত হয়েছে। ফিরে যাচ্ছে সে। গেটের কাছে যেই এসেছে এমন সময় উপর থেকে গভীর গলায় আওয়াজ এলো, কে?
চমকে উঠলে শহীদ। উঃ, কী ভারি গলা?
আমি অনাথ চক্রবর্তী, রায়পুরার জমিদার। আমি এই পাশের হোটেলে উঠেছি। আপনার বাজনা শুনে এসেছিলাম ভালো করে শুনতে। অনধিকার প্রবেশের জন্যে ক্ষমা চাইছি।