.
লম্বা, দীর্ঘদেহী এক বৃদ্ধ ঢুকলেন সেড্রিকের খাবার কামরায়। সামান্য ঝুঁকে হাঁটছেন তিনি। বয়েসের ভারে নুয়ে পড়েছেন যেন। পরনে শাদাসিধে কালো আলখাল্লা। পায়ে থ্যাবড়া জুতো। কোমরে মোটা কাপড়ের ফিতে, তার এক দিকে একটা ছুরি ঝোলানো, অন্য দিকে ছোট একটা চামড়ার বাক্সে লেখার সাজসরঞ্জাম। মাথায় হলদে রঙের অদ্ভুতদর্শন এক টুপি, ইহুদী সম্প্রদায়ের লোকেরাই কেবল এ ধরনের টুপি পরে।
সেড্রিক এবং ঘরের অন্যদের দিকে তাকিয়ে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালেন বৃদ্ধ। তারপর দাঁড়িয়ে রইলেন চুপচাপ, কি করবেন কিছু বুঝতে পারছেন না। তার অভিবাদনের জবাব দেয়নি কেউ, কেউ তাকায়নি পর্যন্ত তার দিকে। অবশেষে সেড্রিক সামান্য মাথা নেড়ে চাকরবাঁকরদের টেবিলটা দেখিয়ে বসতে ইশারা করলেন তাঁকে।
ধীর পায়ে এগোলেন বৃদ্ধ নিচু টেবিলটার দিকে। আগুনের পাশের চেয়ারটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তীর্থযাত্রী। অদ্ভুত এক মায়া অনুভব করছে সে বৃদ্ধের জন্যে। নিজের শূন্য চেয়ারটা দেখিয়ে বললো, আপনি এখানে। বসুন। আমার খাওয়া শেষ, কাপড়ও শুকিয়ে গেছে।
ঘরের সব কটা চোখ এক সাথে ঘুরে তাকালো তীর্থযাত্রীর দিকে। আর বৃদ্ধ ইহুদী অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন সেড্রিকের দিকে। বুঝতে পারছেন না তরুণ তীর্থযাত্রীর আহ্বানে সাড়া দেয়া উচিত হবে কিনা।
কই এখানে এসে বসুন, আবার বললো তীর্থযাত্রী।
ভয়ে ভয়ে এগোলেন বৃদ্ধ চেয়ারটার দিকে। তীর্থযাত্রী আগুনে কয়েকটা কাঠ গুঁজে দিয়ে টেবিল থেকে কিছু খাবার নিয়ে দিলো তাকে। তারপর দ্রুত গিয়ে বসে পড়লো ঘরের অন্য প্রান্তে একটা নিচু চেয়ারে। তাকে ধন্যবাদ জানানোর সুযোগটুকুও পেলেন না বৃদ্ধ আইজাক।
ধীরে ধীরে ঘরের আবহাওয়া স্বাভাবিক হয়ে এলো আবার। একটা দুটো করে কথা ফুটতে লাগলো সবার মুখে। অবশেষে পানপাত্র তুলে নিলেন সেড্রিক।
স্যার ব্রায়ান, তিনি বললেন, আসুন, যে সব সাহসী নাইট প্যালেস্টাইনে জীবনপণ করে লড়ছে তাদের নামে এক পাত্র পান করি।
তাহলে আমি আমার স্বগোত্রীয়দের নামেই পান করবো, জবাব দিলো টেম্পলার, ওখানে যারা লড়ছে টেম্পলাররাই তাদের ভেতর সবচেয়ে সাহসী।
না, না, তা কেন, বললেন ধর্মযাজক অ্যায়মার, যে সব নাইট ওখানে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আহত, অসুস্থ ক্রুসেডারদের সেবা করছে তাদের নামেও পান করা উচিত, বলতে বলতে তিনি তাঁর গেলাস তুলে নিলেন।
আমার কোনো আপত্তি নেই, মাঝখান থেকে ফোড়ন কাটলো ওয়াম্বা। গম্ভীর স্বরে বললো, তবু একটা কথা বলতে চাই, রাজা রিচার্ড যদি আমার মতো ভাঁড়ের পরামর্শ চাইতেন তাহলে বলতাম, দেশ থেকে নতুন নতুন নাইটদের না নিয়ে গিয়ে যে সব সাহসী বীরদের কারণে ওখানে আমরা হারছি তাদের ওপর যুদ্ধের ভার দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত থাকলেই পারতেন।
এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলো রোয়েনা। এবার সে কথা বললো সেই মিষ্টি মধুর স্বরে।
রাজা রিচার্ডের বাহিনীতে কি টেম্পলার আর হসপিট্যালার (আহত ও অসুস্থ সৈনিকদের সেবা শুশ্রুষায় নিয়োজিত ক্রুসেডার) ছাড়া আর কোনো বীর নেই যাদের কথা একটু বিশেষভাবে বলা যায়?
সত্যি কথা বলতে কি, না, মিলেডি, জবাব দিলো ব্রায়ান। প্রচুর। ইংরেজ নাইটকে প্যালেস্টাইনে নিয়ে গেছেন রিচার্ড। তারা সত্যি সত্যিই সাহসী, বীর এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবু, আমি বলতে বাধ্য, বীরত্বে তারা সবাই টেম্পলারদের নিচে।
মিথ্যে কথা! চিৎকার করে উঠলো তীর্থযাত্রী।
প্রত্যেকেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন তার দিকে।
মিথ্যে কথা, আবার বললো সে। রাজা রিচার্ডের নাইটরা বীরত্বে কারো চেয়ে নিচে নয়। বরং আমি বলবো উপরে। তারাই সবচেয়ে সাহসের পরিচয় দিয়েছে।
কি বলছো জেনে, বুঝে বলছো তো? শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো টেম্পলার।
নিশ্চয়ই। প্রমাণ চান? তাহলে বলছি শুনুন: অ্যাকর-এর প্রতিরোধ চূর্ণ করে ক্রুসেডাররা যখন শহরটা দখল করলো তারপর এক টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছিলেন রিচার্ড। আমি নিজে তাতে উপস্থিত ছিলাম। রিচার্ড তার মাত্র পাঁচজন নাইটকে নিয়ে সেদিন যে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন। এক কথায় অতুলনীয়! যারাই সেদিন তাদের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় নেমেছিলো সবাইকে মুখে মাখতে হয়েছিলো পরাজয়ের কালি। পরাজিতদের ভেতর টেম্পলার ছিলেন মাত্র সাত জন। আমার চেয়ে স্যার ব্রায়ান আরো ভালো জানেন একথা, রোয়েনার দিকে তাকিয়ে শেষ করলো তীর্থযাত্রী।
অপমানে মুখ কালো হয়ে উঠেছে টেম্পলারের। ভয়ানক ক্রোধে তরবারি বের করতে গিয়েও সামলে নিলো। এই বেয়াদব তীর্থযাত্রীকে উপযুক্ত শাস্তি তিনি দেবেন, তবে এখানে না। এখানে তেমন কিছু করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
তীর্থযাত্রীর কাছে স্বদেশবাসী নাইটদের বীরত্বের কথা শুনে ভীষণ খুশি হয়েছেন সেড্রিক।
তীর্থযাত্রী, মৃদু হেসে তিনি বললেন, রিচার্ডের পক্ষে যারা লড়েছিলেন তাদের নাম যদি বলতে পারো আমার হাতের এই সোনার বাজুবন্ধ তোমাকে পুরস্কার দেবো।
পুরস্কারের কোনো প্রয়োজন নেই, এমনিতেই আমি তাদের নাম বলবো। আমার একটা শপথ আছে তাতে বর্তমানে আমার সোনা স্পর্শ করা নিষেধ।
ওয়াম্বা আর চুপ করে থাকতে পারলো না। যদি অনুমতি দেন আপনার হয়ে আমিই না হয় পরবো বাজুবন্ধটা।