টুর্নামেন্টে আমরা যাবো কিনা এখনও বলতে পারছি না, জবাব দিলেন সেড্রিক। আপনাদের এই সব টুর্নামেন্ট আমার একদম ভালো লাগে না। ইংল্যান্ড যখন স্বাধীন ছিল, আমাদের সেই পূর্বপুরুষদের আমলে এর চেয়ে কত ভালো ভালো খেলা ধুলা প্রচলিত ছিলো!
সেড্রিকের কথায় কোনো গুরুত্বই দিলেন না প্রায়োর।
তবু আমরা আশা করবো আপনারা যাবেন, বললেন তিনি। অবশ্য আজকাল যা অবস্থা হয়েছে–ভদ্রমহিলাদের নিয়ে পথ চলাই দায়। তবে আমরা, বিশেষ করে স্যার ব্রায়ান সাথে থাকলে ভয়ের কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না।
স্যার প্রায়োর, শান্ত শীতল কণ্ঠে বললেন সেড্রিক, আমার নিজের তলোয়ার আর আমার বিশ্বস্ত অনুচররাই আমার নিরাপত্তার জন্যে যথেষ্ট। আমরা যদি টুর্নামেন্টে যাই-ও, যাবো আমার বন্ধু অ্যাথেলস্টেনের সাথে। আপনাদের সাহায্য দরকার হবে না। সাহায্য করতে চেয়েছেন বলে ধন্যবাদ। ফাদার অ্যায়মার, আসুন, আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে পান। করি।
আমি পান করবো লেডি রোয়েনার নামে, ভরা গ্লাস তুলে নিতে নিতে বললো টেম্পলার। আড়চোখে সেড্রিকের দিকে তাকিয়ে যোগ করলো, তার চেয়ে যোগ্য আর কাউকে দেখছি না এখানে।
আপনার এই সৌজন্যের জন্যে শুধু ধন্যবাদ জানিয়েই যে নিষ্কৃতি দেবো তা ভাববেন না। এই প্রথম কথা বললো রোয়েনা। টেম্পলারের মনে হলো মিষ্টি মধুর ঘণ্টাধ্বনি হলো যেন ঘরের ভেতর। রোয়েনা বলে চললো, আল্লার কাছ থেকে আমরা প্যালেস্টাইনের সর্বশেষ খবরাখবর শুনতে চাই।
সিরিয়ার সুলতানের সঙ্গে নতুন করে সন্ধি হয়েছে, এছাড়া বলবার মত খবর তেমন কিছু নেই।
কখন যে গাৰ্থ আর ওয়াম্বা এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের ভেতর কেউ খেয়াল করেনি। টেম্পলারের জবাব শুনে ভড় বলে উঠলো, এইসব সন্ধির ফলে আর কিছু না হোক আমার বয়েস বেড়ে যাচ্ছে খামোকা।
আরে, ওয়াম্বা, তুই কখন এলি? সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন সেড্রিক। ওয়াম্বার পাশে গার্থকে দেখে স্বস্তি বোধ করলেন তিনি।
এই তো, স্যার, কিছুক্ষণ আগে, আপনারা কথা বলছিলেন তখন।
তা কি যেন বলছিলি তুই, বয়েস বেড়ে যাচ্ছে…
হ্যাঁ, স্যার, বিধর্মীদের সাথে এই সব সন্ধি করছেন রাজারা, আর আমার বয়েস বেড়ে যাচ্ছে।
ওর কথায় বিরক্ত না হয়ে মৃদু হাসলেন জমিদার। কি যা তা বলছিস?
যা-তা কেন হবে, স্যার? এর আগেও তিনবার সন্ধি হয়েছে। প্রত্যেক বার পঞ্চাশ বছরের জন্যে। সেই হিশেবে আমার বয়েস এখন কমপক্ষে দেড়শো।
ওয়াম্বাকে দেখেই চিনেছে টেম্পলার। অগ্নিদৃষ্টিতে একবার তার দিকে তাকিয়ে সে বললো, আমাদের যেমন ভুল পথ বলে দিয়েছিলে অন্য কোনো পথিকের সাথে অমন আর কোরো না। যদি করো, দেড়শো কেন, আর দেড় বছরও যেন তুমি বাঁচতে না পারে সে ব্যবস্থা আমি করবো।
মানে, স্যার ব্রায়ান ও আপনাদের ভুল পথ দেখিয়ে দিয়েছিলো নাকি? জিজ্ঞেস করলেন সেড্রিক।
ওকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন।
মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে ওয়া।
হতভাগা! বদমাশ! গর্জে উঠলেন সেড্রিক, পথচারীদের তুই ভুল ঠিকানা দিস! চাবকানো দরকার তোকে।
নিরুত্তর ওয়াম্বা। তেমনি মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে এখনও।
শুধু বদমাশ নয়, তুই একটা হাঁদা, গর্দভ! আবার চেঁচালেন সেকি।
সে তো সবাই জানে, ভালোমানুষের মতো মুখ করে জবাব দিলো ওয়াম্বা। কিন্তু আমার চেয়েও যে হাঁদা দুনিয়ায় আছে তা জানেন? আমি তো শুধু ডান বায়ের ভুল করেছি। ডাইনে যেতে না বলে বাঁয়ে যেতে বলেছি; কি এমন বোকামি হলো তাতে? আমার মতো বোকার কাছে পথ জানতে চাওয়া আরো বেশি বোকামি না?
এমন ভঙ্গিতে কথাগুলো বললো ওয়াম্বা যে হেসে উঠলেন সবাই। নাইট টেম্পলার স্যার ব্রায়ান কেবল হাসলো না। কার ভাষায় কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুললো সে। এমন সময় অসওয়াল্ড এসে খবর দিলো, অচেনা এক লোক এসেছে। রাতের মতো আশ্রয় চাইছে।
মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল টেম্পলারের।
যে-ই হোক, ঢুকতে দাও তাকে, আদেশ করলেন সেড্রিক।
চলে গেল অসওয়াল্ড। একটু পরেই ফিরে এসে মনিবের কানে কানে ফিসফিস করে বললো, লোকটা ইহুদী, স্যার। নাম আইজাক। ইয়র্কের লোক। এখানেই নিয়ে আসবো ওকে?
নিশ্চয়ই, বললেন সেড্রিক।
একটু ইতস্তত করে অবশেষে অসওয়াল্ড বলেই ফেললো, ওকে নিয়ে আসার জন্যে আমাকেই যেতে হবে, স্যার?
কি দরকার? গার্থের ওপর চাপাও, সেড্রিক জবাব দেয়ার আগেই বলে উঠলো ওয়াম্বা। একজন ইহুদীকে স্বাগত জানানোর জন্যে শুয়োর-চরানো রাখালই যথেষ্ট।
এতক্ষণে উপস্থিত অন্যরা বুঝতে পারলেন কি নিয়ে কানে কানে কথা বলছিলো অসওয়াল্ড।
হায় মা মেরি! আর্তনাদের মতো শোনালো প্রায়োরের গলা, একজন অবিশ্বাসী ইহুদীকে আমাদের পাশে বসানো হবে।
প্রভু যীশুর সমাধিভূমি উদ্ধারের জন্যে যে যুদ্ধ করছে তার সামনে আসতে দেয়া হবে একজন ইহুদী কুকুরকে? ক্রোধ সেই সাথে হতাশা মেশানো টেম্পলার ব্রায়ানের কণ্ঠস্বর।
নাইট টেম্পলাররা দেখছি ইহুদীদের গায়ের বাতাসও সইতে পারেন, ব্যঙ্গের সুরে মন্তব্য করলো ওয়াম্বা, অথচ ওদের বাসস্থান কেড়ে নিতে তাদের আপত্তি নেই।
এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন সেড্রিক। বিতর্কের অবসান করার উদ্দেশ্যেই যেন তিনি বললেন, মাননীয় অতিথিবৃন্দ! আপনাদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, আপনাদের ভালো লাগুক আর নাই লাগুক, আমার দরজা থেকে কেউ হতাশ হয়ে ফিরে যেতে পারবে না। ইচ্ছা না হলে আপনারা ওর সাথে কথা বলবেন না, বা এক টেবিলে খাবেন না। অসওয়াল্ডের দিকে ফিরলেন তিনি, যাও ওকে নিয়ে এসো। এর পর অন্য এক ভৃত্যের দিকে তাকিয়ে যোগ করলেন, ইহুদী লোকটার জন্যে আলাদা টেবিলের ব্যবস্থা করো।