এলগিটা এলো।
রোয়েনাকে বলে এসো, আজ আর ওর এখানে খেতে আসার দরকার নেই। অবশ্য ও যদি আসতে চায় সে আলাদা কথা।
উনি আসছেন, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো এলগিটা। কাপড় পরা শেষ, আর দুএক মিনিটের ভেতর এসে পড়বেন। প্যালেস্টাইনের খবরাখবর শোনার জন্যে খুবই আগ্রহী দেখলাম ওঁকে।
থাম, ছুঁড়ি! গর্জে উঠলো সেড্রিক। যা বললাম গিয়ে রোয়েনাকে বলে আয়। তারপর ও বুঝবে কি করবে না করবে।
মাথা নিচু করে চলে গেল এলগিটা।
প্যালেস্টাইন! আপন মনে বলতে লাগলেন সেড্রিক। আহ! কি ব্যাকুল হয়ে আছে আমার হৃদয় প্যালেস্টাইনের খবর জানার জন্যে! আমার ছেলে-! কিন্তু না, এ কি ভাবছি আমি! যে আমার অবাধ্য সে আমার ছেলে হতে পারে না। ওর খবর জানার জন্যে কেন আমি ব্যাকুল হবো? হাজার হাজার ক্রুসেডার রয়েছে প্যালেস্টাইনে, ওদের যা হবে ওর-ও তাই হবে। কেন আমি ওর কথা ভাবতে যাবো? না, আমি ওর কথা ভাববো না…
ধীরে ধীরে বুকের ওপর ঝুলে পড়লো স্যাক্সন সেড্রিকের মাথা। অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন তিনি। কপালে দেখা দিলে কুঞ্চন। এমন সময় দরজার বাইরে পদশব্দ পাওয়া গেল। ভৃত্যের সাথে ঘরে ঢুকলেন অতিথিরা।
.
ভেজা কাপড় ছেড়ে নতুন ঝকঝকে দামী কাপড় পরে এসেছেন প্রায়য়ার এবং নাইট। প্রায়োরের পরনে আলখাল্লা, কিনারাগুলো চমৎকার ফারে মোড়া। টেম্পলার পরেছে টকটকে লাল রেশমী টিউনিক। তার ওপরে শাদা লম্বা একটা আলখাল্লা। ডান কাঁধে কালো রঙে ক্রুশ আঁকা।
দুজনের পেছনে সেই তীর্থযাত্রী। তার গায়ে শাদামাঠা কালো জোব্বা, হাতে তীর্থযাত্রীদের লাঠি। নিঃশব্দে হেঁটে গিয়ে আগুনের সামনে একটা চেয়ারে বসলো সে।
উঠে দাঁড়ালেন সেড্রিক অতিথিদের স্বাগত জানানোর জন্যে। গুণে গুণে তিন পা এগোলেন চেয়ার থেকে। তারপর দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, দুঃখিত, আমি আর এগোতে পারবো না। কেন, নিশ্চয়ই আমার ভূতের মুখে শুনেছেন। আপনাদের সবাইকে স্বাগতম আমার রদারউডে। এক মুহূর্ত বিরতি নিয়ে জমিদার বললেন, আমি কিন্তু স্যাক্সন ভাষায় কথা বলবো আপনাদের সাথে, কিছু মনে করবেন না যেন। নরম্যান আমি একদম বলতে পারি না, বুঝিও না।
নীতিগত ভাবে আমি নরম্যান ছাড়া অন্য কোনো ভাষা বলার পক্ষপাতী নই, জবাব দিলো টেম্পলার। নরম্যান হলো রাজদরবারের ভাষা। তবে স্যাক্সনও আমি জানি। যখন সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলতে হয় তখন স্যাক্সন ভাষায়ই বলি।
তেলে বেগুন পড়লো যেন। দপ করে জ্বলে উঠলো সেড্রিকের চোখ দুটো। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিলেন তিনি। রাগ গোপন করে বজ্রকণ্ঠে অতিথিদের বললেন, আপনারা বসুন দয়া করে।
বসলেন প্রায়োর অ্যায়মার। ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্টও বসলো। টেবিলে খাবার পরিবেশন করার আদশে দিলেন সেড্রিক।
ব্যস্ত হয়ে উঠলো ভূত্যরা থালা, বাটি, গ্লাস, ডিশ, গামলা নিয়ে। মিনিট পেরোনোর আগেই টেবিল পূর্ণ হয়ে উঠলো নানারকম উপাদেয় খাবারে। জিভে পানি এসে গেল ধর্মযাজকের। একটু নড়ে চড়ে বসলেন তিনি।
এবার তাহলে শুরু করা যাক, ফাদার, স্যার নাইট, বললেন সেড্রিক।
ঠিক সেই সময় পাশের একটা দরজা স্কুল গেল। এক ভৃত্য চিৎকার করলো, লেডি রোয়েনা আসছেন!
সেড্রিক একটু অবাক হলেন, একটু বোধহয় বিরক্তও। তবু তাড়াতাড়ি উঠে দরজার কাছে গেলেন তিনি।
চারজন দাসীর সঙ্গে ঘরে ঢুকলো লেডি রোয়েনা। উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখালেন, অতিথিরা। সেড্রিক তার হাত ধরে নিয়ে এসে বসালেন নিজের ডান পাশের চেয়ারটায়। টেম্পলারের চোখ চক চক করছে।
এমন রূপসী আমি ভাবতেও পারিনি! বসতে বসতে প্রায়োরের কানে কানে ফিসফিস করলো সে। নাহ্, ফাদার বাজিতে আপনিই জিতবেন মনে হচ্ছে। আপনার কলারের সোনার কাঁটা পূরার সৌভাগ্য আমার হবে না।
আমি তো আগেই বলেছিলাম, একই রকম ফিসফিস করে বললেন অ্যায়মার। এখন দয়া করে একটু চুপ করুন, সেড্রিক আপনার দিকেই চেয়ে আছে।
সত্যিই অসাধারণ সুন্দরী রোয়েনা। অপরূপা শব্দটা বোধ হয় এমন নারীদের জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘাঙ্গিনী, অপূর্ব মুখশ্রী। সে যে হেঁটে এলো চেয়ার পর্যন্ত, সবার মনে হলো রানী আসছেন। দুধের মতো শাদা তার গায়ের রঙ। নীল চোখ দুটোয় মহামূল্য রত্নের উজ্জ্বলতা। সোনালি চুলগুলো ঈষৎ এলো হয়ে ছড়িয়ে আছে কাঁধের ওপর। সাগর রঙের একটা রেশমী পোশাক তার পরনে। হাঁটার সময় মনে হলো সাগরের মতোই ঢেউ উঠছে তাতে।
প্রায়োরের সতর্কবাণী সত্ত্বেও টেম্পলার দৃষ্টি ফেরাতে পারলো না রোয়েনার অনিদ্যসুন্দর মুখ থেকে।
ব্যাপারটা খেয়াল করলো রোয়েনা। সামান্য গোলাপী হলো তার গাল। আস্তে করে মুখের ওপর টেনে দিলো মস্তকাবরণের এক প্রান্ত। রোয়েনার ভাবান্তর দৃষ্টি এড়ালো না সেড্রিকের।
স্যার ব্রায়ান, একটু রূঢ় কণ্ঠেই তিনি বললেন, আমাদের স্যাক্সন তরুণীদের গাল সূর্যের আলোও সইতে পারে না, আপনার মতো যোদ্ধার অগ্নিদৃষ্টি কি করে সইবে?
লজ্জা পেলো টেম্পলার। মাথা নুইয়ে আরেকবার সম্মান জানালো রোয়েনাকে। বললো, যদি আপনাকে দুঃখ দিয়ে থাকি, দিয়েছি অনিচ্ছায়। আমাকে ক্ষমা করবেন। সেড্রিকের দিকে তাকালেন তিনি। আপনার কাছেও আমি ক্ষমা চাইছি। এমন অশোভন আচরণ আর কখনো হবে না আমার দিক থেকে।
মুখ ঢেকে ফেলে আমাদের সবাইকেই শাস্তি দিয়েছেন লেডি রোয়েনা, অ্যায়মার বললেন, যদিও দোষ করেছে মাত্র একজন। আশা করি পরশু টুর্নামেন্টের সময় এতটা নির্দয় উনি হবেন না।