ওর শিয়োস্ত্রাণ খুলে দেখ তো! বললেনগ্র্যান্ডমাস্টার।
কয়েকজন টেম্পলার এগিয়ে এলো। শিরোস্ত্রাণের সামনেটা উঁচু করলো। তারা প্রথমে। দেখলো চোখ দুটো বন্ধ ব্রায়ানের। মুখটা লাল টকটকে। শিয়োস্ত্রাণটা ঘষা কাঁচের মতো হয়ে গেল দেখতে দেখতে। মুখটা হয়ে গেল শাদা। মারা গেছে ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্ট।
চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকালেন গ্র্যান্ডমাস্টার।
ঈশ্বরের বিচার এরকমই! বললেন তিনি।
.
আমি নির্দোষ এবং মুক্ত ঘোষণা করছি এই তরুণীকে, চিৎকার করে উঠলেন গ্র্যান্ডমাস্টার। পরাজিত নাইটের ঘোড়া এবং অস্ত্রশস্ত্রের মালিক এখন বিজয়ী নাইট।
ওগুলোর কোনো প্রয়োজন নেই আমার, বললো আইভানহো। এ বিজয় আমার নয়, ঈশ্বরের।
এমন সময় দূর থেকে ভেসে এলো অনেকগুলো ঘোড়র পায়ের আওয়াজ। দ্রুত এগিয়ে আসছে এদিকে।
একদল সশস্ত্র মানুষ নিয়ে রণক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন ব্ল্যাক নাইট। তাঁর পাশেই একটা ঘোড়ায় বসে আছেন ইহুদী বৃদ্ধ আইজাক। ঘোড়া থেকে নেমে দ্রুত একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন নাইট। আইজাকও ঘোড়া থেকে নামলেন। এবং সোজা ছুটে গেলেন কালো আসনে বসে থাকা রেবেকার দিকে।
আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল, বললেন ব্ল্যাক নাইট। ভেবেছিলাম বোয়া-গিলবার্টকে আমি নিজের হাতে শিক্ষা দেবো। কিন্তু পারলাম না। আইভানহো! কাজটা একদম উচিত হয়নি তোমার। দুর্বল শরীরে এত বড় বিপদের ঝুঁকি নিয়েছে, কোন সাহসে?
কিছু একটা জবাব দিতে গেল আইভানহো। তাকে থামিয়ে দিয়ে রিচার্ড বললেন, হয়েছে, তোমাকে আর ব্যাখ্যা দিতে হবে না…সময় নেই আমার হাতে। সাথে যারা এসেছে তাদের একজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, বোহান, তুমি তোমার কাজ করো।
ম্যালভয়সিঁর দিকে এগিয়ে গেলেন বোহান।
আমি হেনরি বোহান, আর্ল অভ এসেক্স, ইংল্যান্ডের লর্ড হাই কনস্টেবল, রাজদ্রোহের অপরাধে আপনাকে গ্রেফতার করছি।
গ্র্যান্ডমাস্টার যেখানে উপস্থিত সেখানে কে টেম্পলার নাইটদের গ্রেফতারের হুকুম দেয়? গর্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন গ্র্যান্ডমাস্টার।
আমি, শিয়োস্ত্রাণের মুখাবরণ সরিয়ে দিতে দিতে বললেন ব্ল্যাক নাইট। আমি, রিচার্ড, ইংল্যান্ডের রাজা।
আমি বাধা দেবো।
চেষ্টা করে দেখতে পারেন, জনাব গ্র্যান্ডমাস্টার। কিন্তু আমার মনে হয় সে সময় পেরিয়ে গেছে। উপর দিকে তাকিয়ে দেখুন। আপনার মঠের চূড়ায় আমার পতাকা উড়ছে। বুদ্ধিমানের মতো আচরণ করুন। কোনরকম গোলমাল পাকানোর চেষ্টা না করে চুপচাপ থাকুন, আমরা কিছু বলবো না। রাজার বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করেছে শুধু সেই সব টেম্পলারকে আমরা শাস্তি দেবো।
একজন টেম্পলারকে শাস্তি দেয়ার অধিকার গ্র্যান্ডমাস্টার ছাড়া আর কারো নেই। আমি আপনার বিরুদ্ধে রোমে পোপের কাছে নালিশ করবো, রিচার্ড!
সে যা হয় করবেন। আপাতত কিছুদিন আমার নির্দেশ মেনেই চলতে হবে আপনাকে। ব্যাপারটা যদি অপমানজনক মনে করেন, চলে যেতে পারেন এদেশ ছেড়ে।
চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো গ্র্যান্ডমাস্টারের।
টেম্পল-এর নাইটরা, চিৎকার করলেন তিনি, এসো আমার সাথে!
সঙ্গী সাথীদের নিয়ে টেম্পলস্টো ছেড়ে চলে গেলেন গ্র্যান্ডমাস্টার।
রাজা দীর্ঘজীবী হোন! রাজা রিচার্ড দীর্ঘজীবী হোন! চিৎকার করে উঠলো জনতা।
.
এতক্ষণ বাবার কোলে আচ্ছন্নের মতো পড়ে ছিলো রেবেকা। এবার সম্বিত ফিরে পেলো।
বাবা! ফিসফিস করে বললো সে। চলো আমরা যাই।
যাবো, মা। কিন্তু আগে যারা তোর জন্যে এত করলেন তাদের ধন্যবাদ জানাবি না?
না! না! এখন না! অস্থির কণ্ঠে বললো রেবেকা।
কি বলছিস তুই! সবাই আমাদের অকৃতজ্ঞ ভাববে না?
ভাবুক, বাবা। কৃতজ্ঞতা দেখাতে গেলে মহা মুশকিলে পড়ে যাবে তুমি। যে কোনো সময় রিচার্ড তোমার কাছে টাকা চেয়ে বসতে পারেন। বিদেশ থেকে ফিরেছেন, এখন নিশ্চয়ই টাকার খুব দরকার ওঁর।
তা ঠিক, তা ঠিক। চল তাহলে, মা, আমরা চলে যাই।
রেবেকা জানে আইভানহোকে ধন্যবাদ জানাতে গেলে কিছুতেই ও আবেগ রোধ করতে পারবে না। তরুণ খ্রীষ্টান নাইটকে ও যে ভালোবেসে ফেলেছে তা প্রকাশ হয়ে পড়বেই। তাই কাউকে কিছু না বলে চলে গেল ও বাবার সাথে।
২৩. ইংল্যান্ডে আবার স্যাক্সনদের রাজত্ব
সেড্রিকের ইচ্ছা ছিলো, ইংল্যান্ডে আবার স্যাক্সনদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন। অ্যাথেস্টেনকে সিংহাসনে বসাবেন এবং রোয়েনার সাথে বিয়ে দেবেন। কিন্তু তার কোনো ইচ্ছাই পূর্ণ হলো না।
কিছুদিন পর মহা ধুমধামের ভেতর রোয়েনার সাথে বিয়ে হয়ে গেল আইভানহোর। রাজা রিচার্ড যোগ দিলেন সে বিয়েতে। এসময় স্যাক্সন অভিজাতদের সাথে তিনি যে সহৃদয় ব্যবহার করলেন তাতে নরম্যানদের প্রতি সেড্রিকের যে বিদ্বেষ তা অনেকখানি দূর হয়ে গেল। রিচার্ডের রাজত্বে। স্যাক্সন নরম্যান সবাই যে সমান অধিকার ভোগ করবে তা বুঝতে পারলেন।
বিয়ের দুদিন পর রেবেকা এলো লেডি রোয়েনার সাথে দেখা করতে। নতজানু হয়ে রোয়েনার পোশাকের প্রান্ত চুম্বন করলো সে।
এ কি! বিস্মিত রোয়েনা প্রশ্ন করলো।
আমি রেবেকা। আমি ধন্যবাদ জানাতে এসেছি আপনার স্বামীকে। উনি নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন।
তুমি কেন ধন্যবাদ জানাবে, রেবেকা? রোয়েনা বললো। ধন্যবাদ জানাবো তো আমি, জানাবে আইভানহো। অ্যাশবির মাঠে যেদিন ও আহত হয়ে পড়ে গিয়েছিলো সেদিন তুমি ওকে উদ্ধার করে না আনলে, সেবা যত্ন করে ওর ক্ষত সারিয়ে না তুললে কি হতো বলো? সেদিনকার সেই ঋণ যদি কিছুটা হলেও শোধ করা যায় সে জন্যেই ও ছুটে গিয়েছিলো টেম্পলস্টো মঠে। আইভানহোর ঋণ তো আমারও ঋণ। বলল কি করে আমি সে ঋণ শোধ করতে পারি?