অপেক্ষা করছে দর্শকরা। অপেক্ষা করছেন মাননীয় বিচারকমণ্ডলী। অপেক্ষা করছেন এ্যান্ডমাস্টার।
আসামীর পক্ষে এখনও কোনো যোদ্ধা উপস্থিত হয়নি, অবশেষে বললেন গ্র্যান্ডমাস্টার। উপস্থিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা বলুক আসামী।
উঠে দাঁড়ালো রেবেকা। বললো, আমি নির্দোষ। আমাকে যতটুকু সময় দেয়া সম্ভব ততটুকু দেয়া হোক। এর ভেতর যদি কোনো নাইট এসে পড়েন, ভালো, না হলে ঈশ্বর যা করেন হবে।
দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করবো আমরা, বললেন গ্র্যান্ডমাস্টার। এর ভেতর যদি কোনো নাইট না আসে, আগুনে পুড়ে মরতে হবে তোমাকে।
দুঘণ্টা কেটে গেছে। সূর্য মাথার ওপর আসতে আর কয়েক মিনিট মাত্র বাকি। কিন্তু এখনো আসেনি কোনো যোদ্ধা রেবেকাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে।
আরো কয়েকটা মিনিট পেরিয়ে গেল। সূর্য এখন ঠিক মাথার ওপরে।
আর দেরি করা অর্থহীন, বললেন গ্র্যান্ডমাস্টার। রেবেকা, তুমি যে ডাইনী তাতে আর কোনো-
দর্শকদের আকস্মিক চিৎকারে চাপা পড়ে গেল তার কথা।
ঐ আসছে! ঐ আসছে!
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন গ্র্যান্ডমাস্টার। দূরে দেখতে পেলেন একজন নাইটকে। প্রাণপণে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে। দর্শকদের ভেতর উল্লসিত একটা রব উঠলো। মেয়েটার তাহলে আশা আছে!
পৌঁছে গেছে অশ্বারোহী লড়াইয়ের জায়গায়। দর্শকরা দুপাশে সরে গিয়ে পথ করে দিলো। গ্র্যান্ডমাস্টারের সামনে গিয়ে ঘোড়া থামালো নাইট। তার চেহারা দেখে হতাশ হলো দর্শকরা। গায়ে যোদ্ধার পোশাক আছে বটে, কিন্তু ভঙ্গিতে কেমন যেন ক্লান্ত ভাব নাইটের। দেখেই বোঝা যায়, শারীরিক দিক থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ সতেজ নয় সে। এ কেমন করে লড়বে বোয়াগিলবার্টের মতো বীরের সাথে?
আমি একজন সত্যিকারের নাইট, উচ্চবংশীয়, ঘোষণা করলো অশ্বারোহী, আমি রেবেকার নির্দোষিতা প্রমাণ করতে এসেছি। বোয়াগিলবার্টের সাথে লড়বো আমি।
নাম কি তোমার, নাইট? জিজ্ঞেস করলেন গ্র্যান্ডমাস্টার।
শিরোনাস্ত্রের সামনেটা উঠিয়ে দিলো নাইট, আমি উইলফ্রিড অভ আইভানহো।
এখন তো আমি তোমার সাথে লড়বো না, বললো বোয়া-গিলবার্ট। তোমার ক্ষত আগে সম্পূর্ণ শুকিয়ে নিক, তারপর দেখা যাবে।
হাহ, টেম্পলার! চিৎকার করলো আইভানহো, এখনো তোমার অহষ্কার কমেনি? এর ভেতরই ভুলে গেলে, দুদুবার আমার কাছে পরাজিত হয়েছো তুমি?–একবার অ্যার-এ, একবার অ্যাশবিতে। রদারউডে কি বড়াই করেছিলে মনে নেই? এখন যদি তুমি আমার সাথে না লড়ো, সারা ইউরোপে আমি প্রচার করে দেবো, তুমি কাপুরুষ, ভীতু।
স্যাক্সন কুকুর! বড় বাড় বেড়েছে তোমার! ঠিক আছে, বর্শা নিয়ে তৈরি হও মৃত্যুর জন্যে।
আমি তৈরি। গ্র্যান্ডমাস্টারের দিকে ফিরলো আইভানহো। লড়বার অনুমতি চাইছি আমি, মাননীয় গ্র্যান্ডমাস্টার।
আসামী যদি তোমাকে তার চ্যাম্পিয়ন হিশেবে স্বীকার করে নেয়, আমার আপত্তি নেই।
রেবেকার কাছে ছুটে গেল আইভানহো। আমাকে তোমার নাইট হিশেবে মেনে নিচ্ছো, রেবেকা?।
নিচ্ছি! নিচ্ছি। কিন্তু, না! তোমার শরীর তো এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। না, আইভানহো, ঐ নির্দয় লোকটার সাথে লোডড়া না তুমি। কেন আমার সাথে সাথে তুমিও মরবে?
কিন্তু ততক্ষণে যুদ্ধক্ষেত্রের এক প্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়েছে আইভানহো। বোয়া-গিলবার্ট আগেই পৌঁছে গেছে অন্য প্রান্তে।
ট্রাম্পেট বেজে উঠলো। থামলো। শুরু হলো লড়াই।
ভয়ঙ্কর বেগে ছুটলো দুটো ঘোড়া। রণক্ষেত্রের ঠিক মাঝখানে মিলিত হলো দুই যোদ্ধা। মেঘ গর্জনের আওয়াজ তুলে সংঘর্ষ হলো দুটো ঢালে। দুজনেরই বর্শা ছুটলো প্রতিপক্ষের বুক লক্ষ্য করে। তারপর দুজনের ঘোড়া ধাক্কা খেলো একটা অন্যটার সাথে। সঙ্গে সঙ্গে উল্টে পড়ে গেল আইভানহোর ঘোড়া। গতকাল সন্ধ্যা থেকে একটানা ছুটছে সে। আর কত ধকল সইবে বেচারার শরীর?
এমন কিছু যে ঘটবে তা যেন জানাই ছিলো দর্শকদের। বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না তাদের ভেতর।
এদিকে মাটিতে পড়েই এক গড়ান দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে আইভানহো। বোয়া-গিলবার্ট মাঠের অন্য প্রান্তে গিয়ে ঘুরে আসছে আবার। বর্শা বাগিয়ে দাঁড়ালো আইভানহো। এসে গেছে বোয়া-গিলবার্ট। আর কয়েক সেকেন্ড লাগবে ওর কাছে পৌঁছুতে। সে-ও বাগিয়ে ধরেছে বর্শা। দর্শকরা বুঝে নিয়েছে, বেচারা চ্যাম্পিয়নের অবস্থা সঙ্গীন। তার মানে মেয়েটা সত্যিই ডাইনী।
কিন্তু ও কি! আইভানহোর কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে বোয়াগিলবার্ট। হঠাৎ ওর বর্শা বাগিয়ে ধরা হাতটা ঝুলে পড়লো মাটির দিকে। ঘোড়ার পিঠে বসা শরীরটা টলে উঠলো একবার। পর মুহূর্তে জিনের ওপর থেকে উল্টে পড়ে গেল বোয়া-গিলবার্ট। তার ঘোড়া সওয়ার হারিয়ে ছুটে গেল সামনে।
এক লাফে টেম্পলার ব্রায়ানের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো আইভানহো। ইতোমধ্যে বর্শা ফেলে দিয়ে বিদ্যুদ্বেগে খাপ থেকে খুলে নিয়েছে তলোয়ার। টেম্পলারের বুকের ওপর পা তুলে দিয়ে গলায় তলোয়ার ঠেকালো।
হার স্বীকার করো, নয় তো মৃত্যুর জন্যে তৈরি হও! চিৎকার করে বললো আইভানহো।
কোনো জবাব দিলো না বোয়া-গিলবার্ট। নড়লোও না এক চুল।
লড়াই বন্ধের নির্দেশ দিলেন গ্র্যান্ডমাস্টার। ওকে মেরো না, আইভানহো। আমি ঘোষণা করছি তুমিই বিজয়ী হয়েছে।
বোয়া-গিলবার্ট পড়ে আছে মাটিতে। স্থির।